ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবন খাত্তাব (রা) এ জীবনী
পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়
হযরত ওমর ইবন খাত্তাব (রা) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ও ন্যায়পরায়ণ শাসক। তিনি "আল-ফারুক" উপাধিতে ভূষিত হন, যার অর্থ "সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী"। তাঁর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্য অভূতপূর্বভাবে প্রসার লাভ করে এবং ইসলামী প্রশাসন সুসংগঠিত হয়।
জন্ম ও পূর্ববর্তী জীবন
হযরত ওমর (রা) কুরাইশ বংশের আদি গোত্রে ৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাত্তাব ইবন নুফাইল এবং মায়ের নাম হন্তমা বিনতে হিশাম। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আরবের এক শক্তিশালী ও সম্মানিত নেতা ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ
প্রথমদিকে হযরত ওমর (রা) ইসলামের কঠোর বিরোধী ছিলেন এবং মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করতেন। তবে একদিন তিনি তাঁর বোন ফাতিমা (রা) এবং তাঁর স্বামী সাইদ ইবন জায়েদ (রা)-কে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখে হৃদয়ে পরিবর্তন অনুভব করেন। এরপর তিনি সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা)-এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে এবং প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার সহজ হয়।
হযরত ওমর (রা)-এর খলিফা হিসেবে শাসনকাল
৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত আবু বকর (রা) ইন্তেকালের পর তিনি মুসলমানদের খলিফা নিযুক্ত হন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১০ বছর (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। এ সময় ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে এবং ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়।
হযরত ওমর (রা)ইসলামের জন্য অবদান
হযরত ওমর ইবন খাত্তাব (রা)-এর অবদান
হযরত ওমর ইবন খাত্তাব (রা) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং ইতিহাসের অন্যতম ন্যায়পরায়ণ ও শক্তিশালী শাসক। তাঁর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্যের অভূতপূর্ব প্রসার ঘটে এবং শাসনব্যবস্থায় যুগান্তকারী সংস্কার আসে। তাঁর অবদান এতই বিস্তৃত যে তা আজও মুসলিম বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। নিচে তাঁর অবদান বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. ইসলামী সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ
তাঁর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্য দ্রুত বিস্তৃত হয় এবং বহু নতুন অঞ্চল ইসলামের পতাকাতলে আসে। উল্লেখযোগ্য বিজয়গুলো হলো:
- পারস্য সাম্রাজ্য জয়: কাদিসিয়া ও নেহাওয়ান্দের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে।
- বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য জয়: সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশরের বিশাল অংশ মুসলিম নিয়ন্ত্রণে আসে।
- জেরুজালেমের বিজয়: ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওমর (রা) স্বয়ং জেরুজালেমে প্রবেশ করেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে এটি দখল করেন। তিনি সেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করেন।
2. প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার
- ইসলামী প্রশাসনকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করেন।
- নতুন নতুন প্রদেশ গঠন করে সেখানে গভর্নর নিয়োগ করেন।
- কাদিসিয়া, বসরা, কুফা ও ফুসত নামে নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।
- বিচারব্যবস্থার জন্য আলাদা কোর্ট স্থাপন করেন এবং বিচারকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।
(ক) স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা
- বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেন এবং তাদের ওপর শাসকদের প্রভাব বিস্তার নিষিদ্ধ করেন।
- কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হতো।
(খ) কঠোর ন্যায়পরায়ণতা
- একবার তাঁর ছেলে অপরাধ করলে তাকেও শাস্তি দেওয়া হয়, যা তাঁর ন্যায়পরায়ণতার উদাহরণ।
- তিনি বলেন, "যদি আমার শাসনামলে কেউ অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে আমি এর দায়ভার গ্রহণ করব।"
3. ইসলামিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা
- রাষ্ট্রীয় কোষাগার (বায়তুল মাল) প্রতিষ্ঠা করেন।
- দরিদ্র ও অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভাতা চালু করেন।
- সেনাবাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো তৈরি করেন।
৪. অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার
(ক) রাষ্ট্রীয় কোষাগার (বায়তুল মাল) প্রতিষ্ঠা
- তিনি ইসলামী সাম্রাজ্যের জন্য প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় কোষাগার (বায়তুল মাল) প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে রাষ্ট্রীয় আয় সংরক্ষিত হতো এবং জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হতো।
(খ) দরিদ্র ও নিঃস্বদের জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু
- বিধবা, এতিম, বৃদ্ধ এবং কর্মক্ষমতাহীন ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত ভাতা চালু করেন।
(গ) সেনাবাহিনীর জন্য বেতন কাঠামো চালু
- সেনাদের নিয়মিত বেতন ও ভাতা চালু করেন, যা সামরিক বাহিনীকে আরও সুসংগঠিত করে।
৫. হিজরি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন
- তিনি রাসুলুল্লাহ (সা)-এর হিজরতকে ভিত্তি ধরে ইসলামী বর্ষপঞ্জি (হিজরি সাল) চালু করেন, যা আজও মুসলমানদের ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৬. নগর পরিকল্পনা ও অবকাঠামো উন্নয়ন
হযরত ওমর (রা) নতুন শহর প্রতিষ্ঠা ও অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
(ক) নতুন নগর প্রতিষ্ঠা
- কুফা, বসরা, ফুসতসহ কয়েকটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন।
- এসব শহর ইসলামের জ্ঞানচর্চা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
(খ) সড়ক ও পানীয় ব্যবস্থার উন্নয়ন
- রাস্তাঘাট ও পানীয় জলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন।
- বিভিন্ন স্থানে কূপ খনন ও খাল নির্মাণ করেন।
৭. শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
- মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কার করেন।
- শিক্ষা বিস্তারে বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন।
- কুরআন শিক্ষার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেন।
৮. অমুসলিমদের অধিকার ও সহাবস্থান
- তিনি খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।
- জেরুজালেম বিজয়ের পর খ্রিস্টানদের চার্চ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অক্ষত রাখেন।
৯. সামরিক ব্যবস্থার সংস্কার
- মুসলিম বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত করেন।
- সীমান্তে রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করেন।
১০. ব্যক্তিগত জীবন ও সাধারণ জীবনযাপন
- অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজের জন্য ব্যবহার করতেন না।
- নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন এবং সাধারণ খাদ্য গ্রহণ করতেন।
হযরত ওমর (রা)-এর শাহাদাত
- ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে এক পারস্য দাস আবু লুলু ফিরোজ নামক ব্যক্তি ফজরের নামাজের সময় তাঁকে ছুরিকাঘাত করে।
- তিন দিন পর তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সা) ও হযরত আবু বকর (রা)-এর পাশে দাফন করা হয়।
হযরত ওমর (রা)-এর ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণ
১. ন্যায়পরায়ণতা ও কঠোর বিচারনীতি
হযরত ওমর (রা) ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ। একবার তাঁর ছেলে এক অপরাধ করলে তাকেও শাস্তি দেওয়া হয়। তিনি বিচারক ও শাসকদের প্রতি কঠোর ছিলেন এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতেন।
২. সাধারণ জীবনযাপন
তিনি সাধারণ পোশাক পরতেন, নিজ হাতে কাজ করতেন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপব্যবহার করতেন না। তিনি জনগণের সুবিধার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।
৩. জনগণের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি
একবার তিনি রাতে ছদ্মবেশে নগর পরিদর্শন করেন এবং এক দরিদ্র নারীর অবস্থা দেখে নিজে খাবার বহন করে তাঁর ঘরে নিয়ে যান।
হযরত ওমর (রা)-এর শাহাদাত
৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে এক পারস্য দাস আবু লুলু ফিরোজ তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। তিন দিন পর তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং তাঁকে মসজিদে নববীতে রাসুলুল্লাহ (সা) ও হযরত আবু বকর (রা)-এর পাশে দাফন করা হয়।
উপসংহার
হযরত ওমর (রা) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাঁর শাসনকাল ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। তাঁর ন্যায়বিচার, প্রশাসনিক দক্ষতা, সামরিক সাফল্য, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ইসলামের বিস্তারে অসামান্য অবদান আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর নেতৃত্বে ইসলাম শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয় এবং মুসলিম উম্মাহর ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।
আরো জানতে ক্লিক করুন.............................