জামেয়া সুন্দর দালান কিংবা প্রচলিত নিয়মে দেশসেরা মাদরাসার স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে সুন্নী মতাদর্শের অনন্য এক প্রতিষ্ঠান নয় বরং আক্বিদার কারণেই এটি স্বতন্ত্র!
শাহিন শাহে সিরিকোট জামেয়া ওয়ালাদের জলদগম্ভীর অমিয় বানী, ❝কাম করো, দ্বীনকো বাচাও, ইসলামকো বাচাও, সাচ্চা আলেম তৈয়্যার করো।❞
এই মহান বাণীতে দ্বীন-ইসলাম বাঁচাতে সাচ্চা আলেম তৈরি করার কার্যকর ভূমিকা পালন করার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেখানে #সাচ্চা তথা প্রকৃত সত্য বলে বিশেষ একটি বিশেষণ শর্তারোপ করেছেন। কারণ এদেশে ইতিপূর্বে বিশাল বিশাল দালানকোঠা সম্বলিত একাধিক মাদরাসা ও আলকেল্লা পরিহিত লম্বা লম্বা দাঁড়ি-টুপি ওয়ালা হাজারো আলেম থাকলেও হাদিসের বাণী ৭৩ ফেরকার মধ্যে একমাত্র মুক্তির পথ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদার অনুসারী হক্কানি সাচ্চা আলেমের বড়ই সংকট ছিল, এরি প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত হতে মুক্তি দানের লক্ষ্যে কুতুবুল আউলিয়া আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রা.) ১৯৫৪ সনে মসলকে আলা হযরতের উপর জামেয়ার ভিত্তি দিয়ে প্রকৃত আলেম তৈরির বাস্তবিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। এই কার্যকরী প্রদক্ষেপকে ইমাম আজিজুল শেরে বাংলা (রা.) বাতেল নিধনের অব্যর্থ তীর হিসেবে চিহ্নিত করেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদার উপর অটল থেকে বাতেল ফেরকার চক্রান্ত মোকাবেলা করার নির্দেশ দিয়ে গাউসে জমান আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রা.) বলেন,
❝বাতেল ফেরকোঁ সে বাঁচো আউর উসকা মোকাবেলা করো।❞ অর্থাৎ, বাতিল দল-উপদল থেকে বেঁচে থাক এবং তাদেরকে প্রতিহত কর।
অনুরূপভাবে গাউসে জমান মুর্শিদে বরহক আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ কেবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলি বায়াত পরবর্তী সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে নসিহত করেন, সেখানে তিনি বলেন,
❝বাতিলপন্থিরা বর্তমানে তৎপর হয়ে উঠেছে। এই বাতিলপন্থিদের কাছ থেকে পৃথক থাকুন। এদের কোন দল ১০০ বছর হতে বের হয়েছে, কোন দল ৮০ বছর হতে বা কোন দল ২০ বৎসর হতে। এই সব বাতিল ফেরকার সংস্রব থেকে দূরে থাকুন।❞
উপরোক্ত মাশায়েখে হযরাতের উপদেশ ও নির্দেশনা থেকে এটাই স্পষ্টত যে, জামেয়া-আনজুমানের মাধ্যমে সাচ্চা আলেম তৈরির মিশনকে এগিয়ে নিয়ে বাতেল মোকাবেলা করে দ্বীন-ইসলামকে ভ্রান্ত মতবাদ ও তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করাটাই আমাদের প্রধান কাজ।
এখন জানার বিষয়, প্রকৃত পক্ষে সাচ্চা আলেম কারা, কিভাবে আলেম হওয়া যায় এবং তাদের যোগ্যতা কি?
সাধারনভাবে শাহিন শাহে সিরিকোটির মিশনের আলোকে এদের পরিচয় হলো, যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের তথা আক্বিদায়ে মসলকে আলা হযরতের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাসী, শরীয়তের বিধিনিষেধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অথবা এ বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন এবং পরহেজগারিতা অবলম্বন করেন, তারাই সাচ্চা আলেম।
জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ারখান নঈমী (রা.) মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবী'তে কিতাবুল ইলম অধ্যায়ে বর্ণনা করেন,
❝ইলম হল নূর, যা আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাহকে দান করেন। যদি কোন মানুষ তা কষ্ট করে অর্জন করে তাকে ইলমে কসবী বলা হয়। পক্ষান্তরে যদি বেলা ওয়াসেতা অর্জিত হয় তাকে বলে ইলমে লাদুনী। এই ইলমে লাদুনী আবার তিন প্রকার। যথা, এক. ওহী, দুই. ইলহাম, তিন. ফেরাসাত। ওহী নবীদের জন্য খাস, ইলহাম অলি আল্লাহদের জন্য আর ফেরাসাত প্রত্যেক মু’মিনের মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাদের ঈমানের পরিমাপ অনুযায়ী। ওহী শরীয়তের অকাট্য প্রমাণ পক্ষান্তরে ইলহাম ও ফেরাসাত যদি খেলাপে শরা তথা শরীয়তের বিপরীত না হয় তবে গ্রহণযোগ্য অন্যথা ওয়াসওয়াসা বা শয়তানী প্রতারণা।❞
আবার যারা সাচ্চা আলেম তাদের যোগ্যতা বেধে আলাদা মর্যাদা রয়েছে। যেমন, কেউ শুধু নিজেকে সঠিক পথে পরিচালনা করার মত যোগ্যতা রাখেন, কেউ পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত জনদের সংশোধন করেন, কেউবা মাহফিল-মজলিশে সাধারণ মানুষকে সচেতন করেন আবার কেউ একাডেমিকভাবে নিম্ম, মধ্যম ও উচ্চ স্তরে শিক্ষা দান ও দ্বীনি বিভিন্ন জটিল বিষয় সমাধান দেওয়ার মত যোগ্যতা রাখেন।
সার কথা হলো, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করার মাধ্যমে আলেম হওয়া যায় না, ঈমান-আক্বিদা শতভাগ পরিশুদ্ধ রেখে খোদাভীতি অর্জন করে প্রকৃত আলেম হতে হয়। ইমামে আজম ও ইমাম বোখারী থেকে শুরু করে ইমাম আলা হযরত পর্যন্ত সমস্ত ইমামগণের মতাদর্শ ও কিতাব গ্রহণযোগ্যতা লাভ করার কারণ শুধুমাত্র তাঁদের জ্ঞানের যোগ্যতার কারণে নয়; তাঁদের আক্বিদা, তাক্বওয়া এবং জ্ঞানের সমন্বিত পূর্নাঙ্গ রূপ তাঁদেরকে আদর্শিক করে তুলেছে। অন্যথায়, ইবনে তাইমিয়া, আশরাফ আলী থানভী ও মৌদুদীদের মত পথভ্রষ্টদেরও আমরা ঈমাম মানতাম আর আধুনিক যুগের গুগল, ইসলামি জ্ঞান সমৃদ্ধ রোবট ও এ্যাপগুলোও বস্তুগত আলেমের তকমা পাওয়ার যোগ্যতা রাখত।
সুতরাং, সুন্নী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মসলকে আলা হযরতের উপর ভিত্তি এই জামেয়ার মূল উদ্দেশ্য দ্বীনের খেদমতকে প্রধান্য দিয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। হাক্বিকত অক্ষুণ্ণ রেখে উপরের সাজ-সরঞ্জাম ও একাডেমিক শিক্ষায় আধুনিকায়ন করলে সেটা পরিপূর্ণ সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে। হাক্বিকত তথা আক্বিদার বিষয়কে গৌণ হিসেবে নিয়ে হযরাতে কেরামের মূল উদ্দেশ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার মত দুঃসাহস থেকে মহান আল্লাহ পাক যেন আমাদের হেফাজত করেন।
পীরে বাঙাল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ সাহেব ক্বেবলা বলেন,
❝আমরা কতইনা ভাগ্যবান যে, আল্লাহ্ পাক এ মহান কাজের জন্য আমাদেরকে বাছাই (বা পছন্দ) করেছেন। যদি আমরা এ কাজে গাফিলতি করি, অলসতা করি, তবে তা আমাদের জন্য হবে ভয়াবহ্ পরিণামের কারণ।❞ তিনি কুরআনে করিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-
وَإِن تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُم (سورة محمد -آية ৩৮)
তরজমা: ❝যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের ব্যতীত অন্য লোকদেরকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন। অতঃপর তারা তোমাদের মত হবেনা।❞
[সূরা মুহাম্মদ: আয়াত: ৩৮, কানযুল ঈমান]
অর্থাৎ অন্য কোন সম্প্রদায়/ব্যক্তিবর্গদের দিয়ে দেওয়া হবে এ সৌভাগ্যের মুকুট, যা হবে আমাদের জন্য বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। আল্লাহ্, আমাদের তৌফিক দিন, আমীন।