ভারত বাংলদেশ সম্পর্ক । India-Bangladesh relations

Muhammad Jamal Uddin
0
                                        ভারত বাংলদেশ সম্পর্ক


হঠাৎ ভারত বাংলদেশকে নিয়ে এতো মাতাল হয়ে গেলো কেন!!" দয়া করে একটু সময় নিয়ে পড়বেন। গত কয়েকমাস ধরে ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে এতো অস্থির হয়ে পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করার কারণ জানতে হলে আপনাকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বুঝতে হবে। চলুন একবার ভারতের পররাষ্ট্রনীতির হট পয়েন্টগুলো দেখে নেয়া যাক। 

  ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয় তা হলো 

এক. পাকিস্তানকে সার্কের বাকী দেশগুলোকে দিয়ে কোণঠাসা রাখা। 
দুই. দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের প্রভাব সংকুচিত করা।
 তিন. দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
 চার. বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এই অঞ্চলের লিড দিয়ে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য নিশ্চিত করা। 


 নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে যে পররাষ্ট্রনীতি ঘোষনা করেছিলো সেটা হলো 'neighbourhood first ' অর্থাৎ প্রতিবেশীর স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু মোদি মুখে বলে একটা কাজ করে অন্যটা। মোদি ক্ষমতায় আসার পর দিল্লী আসলে এই অঞ্চলকে তার নিয়ন্ত্রনে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার ফলে হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। 


 দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ নিয়ে সার্ক গঠিত

দেশগুলো হলো বাংলদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলংকা। প্রথমে আসি নেপাল ও মালদ্বীপ নিয়ে। দেশদুটির সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘদিনের মিত্র নেপাল, মালদ্বীপের মতো দেশে কট্টর ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টাল এখন তুঙ্গে। ভারতবিরোধী হিসাবে পরিচিত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সৈনিক পত্যাহারে বাধ্য করেছে। ভারত-মালদ্বীপের কূটনীতি এখন টানাপোড়নে ঝুলছে। মালদ্বীপ পুরোদমে এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে।এটা ভারতের জন্য একরকম নৈতিক ও কূটনৈতিক পরাজয়। একইভাবে সীমন্ত বিরোধ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে নেপালের জনগনের মাঝে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নেপালের মানচিত্রে ভারতের ভুমি উল্লেখ দেশদুটির মাঝে তিক্ততার ফল। নেপালের প্রধানমন্ত্রী এখন নিজেই ভারতবিরোধী। বুঝাই যাচ্ছে দেশ দুটি ভারতের হাতছাড়া হয়ে গেছে।

 দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকায় তামিলদের পক্ষ নেয়ার কারণে শ্রীলংকানরা ভারতকে সহজে বিশ্বাস করতে পারে না। যদিও বর্তমানে শ্রীলংকা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, দেশটির উপর চীনের প্রভাব এখন প্রচুর। পাকিস্তান ভারতের জন্মগত শত্রু। পারমানবিক শক্তিধর দেশ হলেও ভারত পাকিস্তানকে প্রতিবেশি দেশগুলোকে দিয়ে ঘিরে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু চীনের জন্য পারে না। কাশ্মীর নিয়ে দেশ দুটির মাঝে ইতিমধ্যে চারবার যুদ্ধ হয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটির মাঝে বৈরিতার কারণে সার্ক কার্যত এখন মৃত। আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহ্যগত হলেও দেশ দুটির মাঝে এখন সম্পর্ক টানাপোড়নের দিকে যাচ্ছে। তালেবানেরা চীনের মাধ্যমে তাদের নিজেদের মাঝে শান্তি আলোচনা ও উন্নয়নের অংশীদার হতে চায়। ভারতের সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক উন্নতির দিকে হলেও চীনের মতো প্রভাব রাখতে পারবে না। ভূটানের সাথে ভারতের রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনীতিক সম্পর্ক থাকলেও প্রতিবেশী এই দেশটিতে চীনের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। এক ডোকলাম ভূমি নিয়ে চীন-ভারত-ভূটানের মাঝে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাছাড়া চিকেননেক নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর ভূটানের নাকের ডগায়। এই চিকেন নেক হলো ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায়। যার আয়তন মাত্র ১৭ কিমি। তাই ভারত কখনো প্রতিবেশি এই দেশটিকে হাতছাড়া করতে চায় না। 

 বাংলদেশর প্রসঙ্গ আসলে বলতে হবে জন্ম থেকেই বাংলদেশকে ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু হিসাবে মনে করা হয়। প্রতিবেশী দেশ দুটোর মাঝে সবচেয়ে বেশী সীমান্ত রয়েছে। তাছাড়া দেশ দুটির মাঝে রাজনৈতিক, কূটনীতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ সহযোগীতা করার কারণে দেশটিকে ভারত নিজের রাজ্যের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও যোগাযোগের জন্যে বাংলাদেশকে তাদের একান্ত প্রয়োজন। বাংলদেশের উপর দিয়ে আগরতলা -কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৫৫০ কিমি যেখানে চিকেননেক দিয়ে কলকাতা -আগরতলার দূরত্ব ১৬৫০ কিমি। আর দিল্লি থেকে ২৬৩৪ কিমি। তাই জনরোষ চরমে থাকার সত্ত্বেও বিগত সরকারের করুণায় বাংলদেশের উপর দিয়ে কোনো বিনিময় ছাড়া ভারত স্থল, নৌ ও সমুদ্র ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করে আসছে। 

সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের সেই ট্রানজিট সুবিধা এখন হুমকির মুখে। বাংলাদেশের স্বার্থকে আমলে না নিয়ে ভারত উজানে ফারাক্কা, তিস্তা ও টিপাইমুখি বাঁধ দিয়ে বাংলদেশকে গ্রীষ্ম মৌসুমে সাগর বানিয়ে রাখে , শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমি বানিয়ে রাখলেও গত সরকারের নতজানু কূটনীতির কারণে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া করে নি।। সর্বশেষ ডাম্বুরা বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বৃহত্তর সমতট (কুমিল্লা -নোয়াখালী) অঞ্চলকে পানি দিয়ে ডুবিয়ে মারলো। এই তাজা অভিজ্ঞতা বাংলাদেশিদের জনরোষে আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা। বিগত সরকারের আমলে ফেলানীর মতো সীমান্ত হত্যাকে ভারত নিত্যদিনের ঘটনা বানিয়ে ফেললেও ঢাকা থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করা হতো না। স্বর্ণাদাস ছিলো যার সর্বশেষ সংযোজন। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেটা সম্ভব না দেখে দিল্লী রাগে গরগর করে ফুঁসছে। রোহিঙ্গা ইসু নিয়ে ২০২০ সালে জাতিসংঘে ভুটাভুটি হলে বন্ধুদেশ ভারত ভোটদানে বিরত থাকে, যেখানে পাকিস্তান, মালদ্বীপ বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়। তখন বাংলদেশ সরকারের নিরব ভূমিকা বাংলাদেশী নেটিজনদেরকে উসকে দেয়। ক্রিকেটাঙ্গনেও রয়েছে দিল্লী -ঢাকার মাঝে চরম বৈরিতা। যেটা আমরা আইসিসির টুর্নামেন্ট বা দ্বিপাক্ষিক সিরিজ আসলে তিক্ততা আছ করতে পারি। দেখতে পাই ভারত কিভাবে আইসিসিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেরা সুবিধা নেয়। ২০১৫ সালের কোয়াটার ফাইনালের কথা নিশ্চয় মনে আছে। ভারতের কূটনীতিক আধিপত্য বাংলাদেশি সমর্থকদের মাঝে বারুদ ঝালিয়ে দেয়। বিগত সরকারের আমলে দিল্লীকে মানবদরদী হিসাবে শুধু দিয়েই গেলো। বিনিময়ে কিছু পেলো না। বাণিজ্য অসমতার দিকে তাকাল সব আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ত্রিপুরায় পানি বণ্টন নিয়ে প্রতিবাদ করায় বুয়েটিয়ান আবরারকে নৃশংসভাবে জীবন বলি দিতে হয়। মানুষ এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো!!! রাজনৈতিক দিক থেকে যদি আমরা দেখি ভারত মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে আসছে। ভারত তার অনুগত দলকে ঢাকার রাজনীতিতে ক্ষমতায় দেখতে চায়। সেজন্য তারা যতো কৌশল অবলম্বন করা দরকার সব নেয়। ভারত চায় তার তাবেদার সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিল্লীর সর্বোচ্চ স্বার্থ হাসিল করবে যেটা তারা গত ৫৩ বছর করে আসছে। 

কিন্তু গত ৫ অগাস্ট তাদের পররাষ্ট্রনীতি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য যেটা ছিলো অভ্যুত্থান, দিল্লীর জন্য সেটা ছিলো দিল্লীবিরোধী বিপ্লব। বিপ্লব পরবর্তী সরকারকে দিয়ে তাদের দাসত্ব হবে না জেনে তারা এখন পাগলা কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করছে। ইসকন কার্ড, সংখ্যালঘু কার্ড খেলে ভারত মূলত বাংলাদেশকে স্থিতিশীল হতে দিবে না। তাই তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যার সর্বশেষ সংস্করণ আগরতলায় বাংলদেশি কনস্যুলেট আক্রমণ। যেটা ভিয়েনা কনভেনশনের মারাত্মক লঙ্ঘন। এখন বাংলদেশের সাথে ভারতের যে সমস্যা সেটা পুরোটা রাজনৈতিক। ভারত সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়। আমাদের সনাতন ধর্মের বন্ধুদের বলবো আপনারা দিল্লির রাজনৈতিক ফাঁদে পা দিবেন না। ভারতবিরোধীতা বাংলাদেশিদের মনে রাতারাতি জেগে উঠে নি। উপরিল্লিখিত প্রত্যকটা ঘটনায় বাংলাদেশিদের মনে ভারতবিরোধীতা উসকে দিয়েছে। যেটা এখন তুঙ্গে । একে একে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো হারিয়ে ভারত এখন পাগলের মতো আচরণ করছে। এগুলো করে প্রতিবেশীদের মন জয়তো দূরের কথা, বরং তিক্ততা আরো চরম পর্যায়ে যাবে। অচিরেই দিল্লীর শুভবুদ্ধি উদয় না হলে দিল্লির আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতির কবর রচনা হয়ে যাবে। ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। কেমন বিশ্লেষণ হলো জানাবেন।

 আবদুল আজিজ মাসুদ ৪৩তম বিসিএস শিক্ষা ( ইংরেজি)

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!