তালাক, বিবাহ বিচ্ছেদ ও দেনমোহর আদায়

Muhammad Jamal Uddin
0

 

তালাক, বিবাহ বিচ্ছেদ ও দেনমোহর আদায়


তালাক, বিবাহ বিচ্ছেদ ও দেনমোহর আদায়

                        এস. এম. রেজাউল করিম (বাবর)

                            অ্যাডভোকেট জজ কোর্ট, চট্রগ্রাম। মোবাইল 01815-148097


সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক সুবাহানাহু ওয়া তা'আলার দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছি, সাথে সাথে শফিউল মোজনেবীন রাহমাতুল্লিল আলামীন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে নববীতে কদম মোবারকে অসংখ্য সালাত সালাম পেশ করছি। আম্মা বা'

মানুষ পৃথিবীতে পদার্পন করার পরবর্তীতে যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়, তখন তার বিবাহ নিয়ে সে নিজেই এবং তার পরিবারের মধ্যে অতি ব্যস্ততা বেড়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে সে বিবাহ নামক গন্ডিতে আবদ্ধ হয়। যার ফলে ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যে সংসারের সৃষ্টি হয় এবং এই সংসার দিনে দিনে সন্তান-সন্ততি জন্ম দানের মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হয় কিন্তু মাঝে মাঝে এই সংসারে নেমে আসে কালো মেঘ। মেঘের ভারী বর্ষণে বন্যার পানিতে সংসার নামক জায়গাটি প্লাবিত হয়ে যায় যাকে আমরা স্বাভাবিক ভাষায় সাংসারিক ঝগড়া হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। আর সেই ঝগড়ার পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেগবান হতে থাকলে তখন বিবাহ এবং সংসার নামক শব্দগুলো বিচ্ছেদে পরিণত হয় এবং এই বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক শরীয়াহ আইন অনুযায়ী না হলে তা কার্যকর হয় না। পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ।। তাই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে আইন-কানুন জানা প্রয়োজন আর এই আইনগুলো সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো-

. তালাকের সংজ্ঞাঃ মুসলিম আইন অনুযায়ী তালাক শব্দের অর্থ মুক্তি। স্ত্রীকে বিবাহবন্ধন থেকে স্বামীর মুক্তি দেওয়ার অধিকারকে তালাক নামে অভিহিত করা হয়। পক্ষান্তরে স্বামীকে বিবাহবন্ধন থেকে স্ত্রীর মুক্তি দেওয়ার অধিকারকেও তালাক নামে অভিহিত করা হয়। আর এই অধিকার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য তালাক দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত নিন্দিত হলেও এটা আইন সম্মত তা মৌখিক এবং লিখিত উভয় অবস্থায় হতে হবে।

. তালাকের আইন সিদ্ধ প্রস্তুতিঃ একজন পুরুষ অথবা একজন নারী উভয়ে তালাকের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে চাইলে: সর্বপ্রথম তাকে যে সমস্ত কার্যাদি গ্রহণ করতে হবে তা হল:

. একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর শরণাপন্ন হয়ে তালাকদাতা তালাক গ্রহীতাকে টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হলফ পূর্বক সাক্ষীগণের সম্মুখে প্রদান করে হলফনামা স্বাক্ষর করতে হবে

. উক্ত হলফনামা মাননীয় নোটারি পাবলিকের কার্যালয় হতে সত্যায়িত করতে হবে।

. উক্ত হলফ নামার সাথে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের () ধারা মোতাবেক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মেয়র বরাবরে নোটিশ প্রদান করতে হবে।

. উক্ত নোটিশ সম্বলিত হলফনামা একটি কপি তালাক গ্রহীতার নিকট রেজিস্ট্রি ডাকযোগে পাঠাতে হবে।

 

. তালাক কার্যকরের আইনগত ফলাফলঃ

 ২নং কলামের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পাদনের পর ইউপি চেয়ারম্যান/মেয়র তালাক প্রদানের (তিন) মাসের মধ্যে উক্ত তালাক কার্যকর করার জন্য উভয় পক্ষের নিকট নোটিশ প্রদান করবে এবং তাতে পক্ষ যৌক্তিক সাড়া প্রদান করুক বা না করুক (তিন) মাস পর উক্ত তালাক কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য এভাবে মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন নারী অথবা একজন পুরুষ তার স্বামী অথবা স্ত্রীকে তালাক প্রদান এবং উক্ত তালাক কার্যকর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন এছাড়াও অধিকন্তু কিছু জানার থাকলে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর হয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে।

তালাক, বিবাহ বিচ্ছেদ ও দেনমোহর আদায়



. দেনমোহর আদায়: হযরত আদম আলাইহিস সালাম হাওয়া আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে অদ্যবধি পর্যন্ত স্বামী এবং স্ত্রী দুইটি সত্ত্বা বিবাহের মাধ্যমে এক হয়ে যুগে যুগে সৃষ্টির শুরু থেকে পর্যন্ত পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির 'পর্যায়ক্রমিক ধারা অব্যাহত রেখেছে। আর এই ধারা চলমান অবস্থায় যুগে যুগে বিবাহ নামক শব্দটির সাথে আমরা সকলে সহজে পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ বিবাহের সময় নিকাহনামা দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়ে আমরা তেমন সচেতনতার পরিচয় না দিয়ে যত ইচ্ছা মত পরিমাণ নিকাহনামায় দেনমোহরের পরিমান বসিয়ে থাকি। বলতে গেলে কে কার থেকে কত বেশি দেনমোহর নিকাহনামায় বসাবে তা নিয়ে এক প্রকার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকি অথচ দেনমোহর কি? কেনই বা দেমোহরের প্রচলন, কিংবা দেনমোহর আদায় সম্পর্কে আইনে কি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে চিন্তা করি না অথবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যা ইচ্ছা তা নিকাহনামায় লিপিবদ্ধ করে। উক্ত দেনমোহর আদায়ের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেন নীল আকাশে এক টুকরো মেঘ এসে জমাট বাঁধা

অথচ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স মুসলিম আইনে দেনমোহর এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত আইনবিদ ডি.এফ. মুলা বালেন, "মোহর বা মোহরানা হইলো কিছু টাকা বা অন্য কিছু সম্পত্তি যাহা বিবাহের প্রতিদানস্বরূপ স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে পাইবার অধিকারী।অপর দিকে মাননীয় বিচারপতি মাহমুদ দেনমোহর এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, “বিবাহের প্রতিদান বা পণস্বরূপ যে অর্থ বা সম্পত্তি স্বামী স্ত্রীকে দেন বা দিতে অঙ্গীকার করেন, উহাই ইসলামী আইনে দেনমোহর হিসেবে অভিহিত হয়।তাছাড়াও বেইলি বলেন, "বিবাহচুক্তির ফলশ্রুতি স্বরূপ কোন অর্থ কিংবা অন্য কোন সম্পত্তি যাহা স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে পাওয়ার অধিকারী হয়, উহাই দেনমোহর।" উক্ত সংজ্ঞা সমূহ হতে বুঝা যায় যে, নিকাহনামায় দেনমোহরের আবশ্যকতা খুবই জরুরি। তাছাড়াও উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলায় ব্যাপারে বহু রেফারেন্স রয়েছে

তন্মধ্যে হামিদা বিবিন্ন মামলায় দেনমোহরের গুরুত্ব সেটার মূল্যায়ন সম্পর্কে অভিমত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে। তা হলো: “ বিবাহের মর্যাদার চিহ্নস্বরূপ দেনমোহর একটি অবশ্যম্ভাবী দায়িত্ব। এই দায়িত্ব এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বিবাহের সময় নির্ধারিত না থাকলেও আইন পরবর্তীকালে সেটার নির্ধারণের ব্যবস্থা করেছে।

স্বাভাবিকভাবে কখন দেনমোহর নির্ধারিত করতে হয় সে ব্যাপারে বিশ্লেষণ করা হল। মোহরানা কখন নির্ধারিত করতে
হবে সে সম্পর্কে কোনো ধরা-বাধা নিয়ম নেই। বিবাহের পূর্বে, বিবাহের মজলিসে মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণ করা
যেতে বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের মজলিসে মোহরানা ধার্য হয়ে থাকলেও বিবাহের পর উভয় পক্ষের সম্মতিতে সেটার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়াও কে বিবাহের দেনমোহর ধার্য করে থাকেন, সেটা বিশ্লেষণ করা হল- বিবাহের মোহরানা সাধারণতঃ উভয় পক্ষের প্রধান ব্যক্তিরা মারফত ধার্য করে থাকেন। কিন্তু যে কেউ ধার্য করে থাকুক না কেন আইনত স্বামী সেটা ধার্য করেছেন বলে গণ্য হবে তদুপরি দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করতে গেলে কিছু ব্যাপার উভয় পক্ষের সচেতন এবং সজাগ দৃষ্টিপাত করতে হয়। যাতে বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী উপযুক্ত দেনমোহর পাওয়ার অধিকার হতে বঞ্চিত না হয়। এবং দেনমোহরের পরিমাণ কত হবে তা নির্ধারণ করতে গেলে বর-কনের পক্ষের সামাজিক অবস্থান, বংশমর্যাদা, কনের ব্যক্তিগত, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সৌন্দর্য এবং বরের শিক্ষাগত যোগ্যতা আর্থিক সঙ্গতি এবং চাকুরি কিংবা ব্যবসায় পদমর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করা উচিত। সর্বোপরি ইত্যাদি বিবেচনায় উভয়ের মধ্যে দেনমোহর নির্ধারণ করতঃ বিবাহ সম্পন্নের পর যদি উক্ত বিবাহ কোন কারণে বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হয়, তবে স্ত্রী যদি দেনমোহর উদ্ধারের নিমিত্তে তথা দেনমোহর আদায়ের জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চায়, সেক্ষেত্রে স্ত্রীর যে স্থানে বসবাস করে বাসস্থানটি যে আদালতের এখতিয়ারাধীন স্ত্রী সেখানে মামলা দায়ের করতে পারবেন

স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকলে

তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী যদি অন্তঃসত্ত্বা থাকেন, সে ক্ষেত্রে নিয়ম একটু ভিন্নতর। তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরও যদি স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকেন, তাহলে যেদিন সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, সেদিন তালাক কার্যকর হবে। এর আগে নয়। কিন্তু নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন আগেই যদি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তবে স্বাভাবিক নিয়মে, অর্থাৎ ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।


প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, অপরিশোধিত দেনমোহর একটি ঋণ। স্ত্রী যে কোন মুহুর্তে সাংসারিক জীবনে স্বামীর নিকট উক্ত প্রাপ্য দেনমোহর চাইতে পারে এবং স্বামীও উক্ত দেনমোহর স্ত্রীকে প্রদান করতে বাধ্য। এতে অর্থাৎ দেনমোহর পরিশোধের ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ বাধ্যতামূলক নয়



সম্মানিত পাঠকবৃন্দের নিকট অনুরোধ রইল, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বিবাহের ক্ষেত্রে সামাজিক লোক দেখানো দেনমোহর নির্ধারণ না করে সঠিক দেনমোহর নির্ধারণ করতঃ স্ত্রীকে তার প্রাপ্য দেনমোহর যথাযত মর্যাদার সাথে পরিশোধ করা উত্তম

মুসলিম আইন অনুযায়ী দেনমোহর খোরপোষ আদায় কিভাবে করা হবে তার সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করতে অবহেলা বা অস্বীকার করেন, তাহে স্ত্রীর খোরপোষের দাবিতে দেওয়ানী মামলা দায়ের করতে পারেন কিন্তু কাবিননামায় অথবা অন্য কোন প্রক্রিয়ায় যা সুস্পষ্ট কোনো না থাকে, তাহলে যে সময় অতীত হয়ে গিয়েছে, সে সময়ের জন্য তিনি খোরপোষের দাবি করে পারেন না।

তাছাড়াও যদি নির্দিষ্ট কোন হেতু তে স্ত্রী তার স্বামীর সঙ্গ ত্যাগ নতুবা স্বামী কত বা কোন তারিখ হতে স্ত্রীকে তার প্রাপ্য
খোরপোষ হতে বঞ্চিত করেছে, তা যদি স্ত্রী নির্ধারণ করতে পারে, তবে স্বামী উক্ত স্ত্রীর খোরপোষ প্রদানে বা্ধ্য।
তাছাড়াও ১৯৬১ সালের পারিবারিক অধ্যাদেশ অনুসারে স্ত্রীর খোরপোষ এর দাবি জানিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে/
চেয়ারম্যান/কাউন্সিলরের নিকট কিংবা মেয়র বরাবর দরখাস্ত করতে পারেন চেয়ারম্যান/কাউন্সিলর/মেয়র স্ত্রী স্বা
প্রতিনিধিসহ তিন জনকে নিয়ে একটি সালিশী পরিষদ গঠন পূর্বক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, মাসিক
টাকা হারে স্ত্রীর খোরপোষ নির্ধারিত হবে এবং উক্ত ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে সার্টিফিকেটও প্রদান করতে পারেন। যদি স্ত্রী পক্ষ সন্তুষ্ট না হয়, তবে তিনি খোরপোষ আদায়ের লক্ষ্যে বিজ্ঞ আইনজীবির পরামর্শ বিজ্ঞ পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন এক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালত সকল দিক বিবেচনা করে খোরপোষ নির্ধারণপূর্বক মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন

পরিশেষে, মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মে (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)' অনুপম আদর্শে আদর্শিত হয়ে সুখী সুন্দর জীবন গড়ার সুযোগ করুন

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!