খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রঃ) জীবনী PART 1

Muhammad Jamal Uddin
0

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রঃ) জীবনী PART 1

জন্ম এবং বংশ পরিচয়
সিস্তানের অন্তর্গত সঞ্জর গ্রামে হিজরী ৫৩৬ সনের ১৪ই রজবের এক উজ্জ্বল প্রভাতের শুভ মুহূর্তে যুগ যুগান্তের আলোকবার্তা বহন করিয়া জগতে আগমন করিল একটি ছোট শিশু। এই শিশুর নাম খাজা মুঈনুদ্দীন হাছান সঞ্জরী।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রঃ) এর পিতার নাম গিয়াসউদ্দীন হাছান (রহঃ)। তিনি ছিলেন অন্তর্গত সঞ্জর গ্রামের অধিবাসী। তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। অঢেল ধন-সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। তবে শুধু ধন-সম্পদই তাঁহার কাম্য ছিল না। তিনি ছিলেন একজন মহাজ্ঞানী ও মহাসাধক। দিবাভাগে তিনি ব্যবসা করিতেন আর রাতের বেলা আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকিতেন। ভক্তবৃন্দ তাঁহার সান্নিধ্য লাভ করিয়া ধন্য হইত।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রঃ) মাতা সাইয়েদূর উম্মুল ওয়ারাও ছিলেন খোদা ভক্ত, সতী সাধ্বী রমণী সংসার কার্য পরিচালনা, স্বামীর খেদমত, ছেলে-মেয়েদের লালন-পালন ও আল্লাহর ইবাদত ব্যতীত তাঁহার অন্য আর কাজ ছিলনা ।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয় দিক হইতেই তিনি ছিলেন সাইয়্যেদ বংশীয়। নিম্নে তাঁহার পূর্বপুরুষদের বংশ তালিকা বর্ণনা করিতেছি।

পিতৃকুল ঃ

হযরত আলী মুরতাজা (রাঃ) 

হযরত ইমাম হোছায়েন (রাঃ)

হযরত জয়নুল আবেনীন (রহঃ)

হযরত ইমাম বাকের (রহঃ)

হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ)

হযরত মুসা কাযেম (রহঃ) হযরত ইমাম মুসা আলী (রহঃ)

হযরত সৈয়দ ইব্রাহীম (রহঃ) সৈয়দ আবদুল আযীয (রহঃ)

হযরত সৈয়দ তাহির (রহঃ)

হযরত সৈয়দ আহমদ হোসেন (রহঃ) হযরত সৈয়দ খাজা কামালুদ্দীন (রহঃ)

হযরত সৈয়দ খাজা গিয়াসউদ্দীন (রহঃ) হযরত সৈয়দ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ)


জনক জননীর পরলোক গমন ঃ

ধনী পিতা খাজা গিয়াসুদ্দীনের আদরের দুলাল বালক মুঈনুদ্দীন (রহঃ) দিনগুলি পরম সুখেই অতিবাহিত হইতেছিল। জনক-জননীর মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসায় আদর-যত্নে পরম আনন্দেই বালক মুঈনুদ্দীন (রহঃ) তাহার দিনগুলি কাটাইতেছিলেন। সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা বলিতে তাঁহার কিছুই নাই। জীবন পথের ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রামী জীবনের কঠোর বাধা কোন কিছুই তাঁহাকে সহ্য করিতে হয় নাই ।কিন্তু ৫৫১ হিজরীতে খাজা মুঈনুদ্দীন (রহঃ) মাত্র পনের বৎসর বয়সে তাঁহার পিতার পরপারের ডাক আসিয়া পড়িল। বালক খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) কে ইয়াতীম করিয়া দিয়া পিতা খাজা গিয়াসউদ্দীন অমর লোকে পরম প্রভুর দরবারে চলিয়া গেলেন ।

পিতার মৃত্যুতে বালক মুঈনুদ্দীন (রহঃ) চারিদিকে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার কোমল হৃদয় পিতৃশোকে হাহাকার করিয়া উঠিল। জননী তাঁহাকে সান্ত্বনা দিলেন-“বাবা! তুমি বিচলীত হইওনা, দুঃখ করিওনা, মহান প্রভু আল্লাহ পাকই তোমাকে সুপথ দেখাইবেন।”

কিন্তু তাঁহার সহজ সরল জননী তখন ভাবিতেই পারেন নাই যে, মুঈনুদ্দীন চিশতী। (রহঃ) কে সুপথে গমন করিতে কত বিপদের সম্মুখীন হইতে হইবে। কত আঘাত কত বিপদ তাঁহাকে অতিক্রম করিতে হইবে।পিতার মৃত্যুর পর কিছুদিন যাইতে না যাইতেই আবার মুঈনুদ্দীন চিশতী এর (রহঃ) উপর আবার এক আঘাত নামিয়া আসিল। তাঁহার পরম স্নেহ দায়িনী জননী বিবি উম্মুল ওয়ারা তাঁহাকে চিরদিনের মত বিদায় দিয়া পরলোক গমন করিলেন।
জননীর মৃত্যুর পর সংসারে তাঁহার আশ্রয়দাতা বলিতে আর কেহই রহিল না। পিতা-মাতা দুইজনই হারাইয়া শোকে দুঃখে আঘাতে মুঈনুদ্দীন (রহঃ) একেবারেই ভাঙ্গিয়া পড়িলেন ।

দরবেশ ইব্রাহীম কানদুষীর সাক্ষাত লাভ ঃ

পিতার মৃত্যুর পর খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) ওয়ারীশ সূত্রে একটি ফলের বাগান ও গম পিষিবার একটি যাঁতা প্রাপ্ত হইয়াছিল। ইহা দিয়াই তিনি কোনও রকমে জীবিকা নির্বাহ করিয়া চলিলেন ।তাহার বাগান দেখাশুনা করিবার কোন লোক ছিল না। তিনি নিজেই উহার দেখাশুনা করিতেন। নিজেই বৃক্ষমূলে পানি দিতেন, নিজের হাতেই আটা পিষিয়া রুটি তৈরি করিতেন।

একদা বাগানের কাজ করিতে করিতে পরিশ্রম এবং রৌদ্রতাপে ক্লান্ত হইয়া তিনি বাগানের একটি বৃক্ষমূলের ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম করিতে ছিলেন। এমন সময় সেইখানে ওলীয়ে কামেল দরবেশ “ইব্রাহীম কানদুষী” উপস্থিত হইলেন ৷ তিনি সারা জীবন শুধু আল্লাহর ইবাদত আর দেশভ্রমণ করিয়া জীবন কাটাইয়াছিলেন । দুনিয়ার প্রতি তাহার বিন্দু মাত্রও আসক্তি ছিলনা ।যুবক মঈনুদ্দীন তাঁহাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন ও ভক্তিভরে তাঁহাকে একটি বৃক্ষছায়ায় উপবেশন করাইয়া একগুচ্ছ আঙ্গুর আনিয়া তাঁহার সম্মুখে রাখিলেন।দরবেশ মাত্র দুই একটি আঙ্গুর মুখে দিলেন। অতঃপর নিজের পুটলী হইতে এক টুকরা রুটি বাহির করিয়া উহা স্বীয় দাঁত দ্বারা চিবাইয়া মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রহঃ) হাতে দিয়া বলিলেন-নাও এই টুকরাটি তুমি খাইয়া ফেল ।

মুঈনুদ্দীন চিশতী তাঁহার আদেশ পালন করিয়া ভক্তি সহকারে উহা ভক্ষণ করিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! রুটির টুকরাটি খাইয়া ফেলিবার সাথে সাথেই তাঁহার দেহ ও মনে এক নতুন আলোড়ন ও ভাবের সৃষ্টি হইয়া গেল । কলব হইতে পাপময় জগতের সর্বপ্রকার পঙ্কিলতা দূর হইয়া উহা অপূর্ব জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল । এশকে ইলাহীর পুণ্যময় আকর্ষণ তাঁহার মনোজগতে এক বিরাট পরিবর্তন অতঃপর দরবেশ বিদায় নিয়া চলিয়া গেলেন। কিন্তু যে প্রেমাগ্নি তিনি খাজা, মুঈনুদ্দীন (রহঃ) এর অন্তরে জ্বালাইয়া গেলেন উহা তাহাকে পাগল করিয়া তুলিল । তিনি বাগান ও যাঁতা বিক্রয় করিয়া সকল বিক্রয়লব্ধ অর্থ দ্বীন দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করিয়া দিয়া আল্লাহর নামে বাহির হইয়া পড়িলেন।

ছাত্র জীবন ঃ


"যে ব্যক্তি এলমে দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে বাহির হয়, ফিরিয়া আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথেই থাকে।" (আল হাদীস) ।
এলেম শিক্ষা করার বিপুল তৃষ্ণা অন্তরে নিয়া খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী ঘরবাড়ী আগ করিয়া প্রথমে তিনি সমরখন্দে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ।তৎকালে সমরখন্দ ও বোখারা ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত ছিল। বহু দার্শনিক মুহাদ্দেছ ফকিহ এবং পণ্ডিতগণ তথায় বসবাস করিতেন। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) প্রথমে সেখানে কোরআন শরীফ মুখস্ত করিলেন । অতঃপর তাফসীর, হাদীস, ফেকাহ, ওসুল, মান্তেক ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করিলেন। তাঁহার স্মৃতিশক্তি ছিল অতি প্রখর। সুতরাং কোরআন শরীফ আয়ত্ব করিতে তাফসীর, হাদিস ইত্যাদি শিক্ষা করিতে তাঁহার খুব অল্প সময়ই লাগিয়াছিল । একনিষ্ঠ ভাবে সাধনা ও অধ্যাবসায়ের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই অতিশয় দক্ষতা অর্জন করিলেন ।যাহেরী পারদর্শিতা ভাল করিয়াও তাঁহার তৃষ্ণার মনের জ্ঞান পিপাসা নিবৃত্ত হইল না । আধ্যাত্মিক জগতের জ্ঞান অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় তিনি বোখারা হইতে আবার নিরুদ্দিষ্ট পথে যাত্রা করিলেন।

পীরানে পীরদের পরিচয় ঃ

খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ)

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) যাহার মুরীদ ছিলেন তিনি হইলেন হযরত খাজাওসমান হারুনী (রহঃ)।
খোরাসান ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানে নিশাপুরের অন্তর্গত হারুন নামক একটি শহরে হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) সৈয়দ বংশের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আউলিয়াগণের মাথার মুকুট। শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ)-এর বংশের একাদশ অধঃস্তনীয় পুরুষ ছিলেন। অতি শৈশবেই তিনি কোরআন মজীদ হেফজ করেন। তারপর অতি সুনামের সহিত নিশাপুরস্থ দারুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা হইতে সর্বশ্রেষ্ঠ ডিগ্রী অর্জন করিয়া অতিশয় যোগ্যতার পরিচয় লাভ করেন। তিনি জাহেরী বিদ্যায় সেই যুগের শ্রেষ্ঠ বলিয়া প্রসিদ্ধ লাভ করেন।

হযরত খাজা ওসমান হারুনীর (রহঃ) পীর ছিলেন হযরত খাজা শরীফ জিন্দানী (রহঃ)। তিনি হযরত খাজা শরীফ যিন্দানীর মুরীদ ছিলেন। তিনি হযরত খাজা শরীফ যিন্দানীর (রহঃ) নিকটেই মারেফাত শিক্ষা অর্জন করেন ।হযরত খাজা ওসমান হারুনীর (রহঃ) কৃচ্ছ সাধনা ছিল অতুলনীয়। বর্ণিত আছে, সত্তর বৎসর যাবত তিনি কখনও শয়ন করেন নাই। প্রত্যহ দিবা-রাজে তিনি দুইবার করিয়া কোরআন শরীফ খতম করিতেন। কখনও কখনও তিনি তিনদিন অন্তর কখনও বা পাঁচ-সাতদিন অন্তর তিনটি অঙ্গুলিতে করিয়া যে পরিমাণ খাদ্য উঠিতএইরূপ তিন চার লোকমা আহার করিতেন । প্রতি সপ্তাহে একদিন মাত্র এক ঢোক পানি পান করিতেন। এইভাবে অকল্পনীয় কৃচ্ছ সাধনার দ্বারা তিনি রুহানী ক্ষমতা এমন ভাবে বৃদ্ধি করিয়াছিলেন, যাহার নানার সর্বশ্রেষ্ঠ অলাকপে পরিগণিত হইয়াছিলেন।

হযরত খাজা ওসমান হারুনীর (রহঃ) কারামত সম্পর্কে অনেক কাহিনী বর্ণিত আছে। একদা একবার এক বৈঠকে তাঁহার কারামত সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। - কতিপয় লোক তাহাতে কিছুটা সন্দিহান হইয়া পরামর্শ করিল যে, আমরা সত্তর জন লোক একযোগে রাত্রিতে যাইয়া তাহার নিকট নতুন তাম্র বরতনে মনের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকার খাবার খাইতে চাহিব। তবে ইহা মুখে না বলিয়া মনে মনে কামনা করিব ।তারপর তাহারা এইরূপ বাসনা নিয়া খানকাহ শরীফে উপস্থিত হইলে তিনি তাদের সকলের নাম ধরিয়া ডাকিয়া বলিলেন, আসো আল্লাহর বান্দাগণ । পরম প্রভু আল্লাহ তায়ালা গুপ্ত প্রকাশ্য সবই অবগত আছেন। আর তাঁহার বন্ধুগণ ও তাঁহারই শিক্ষা ও এনায়েত অনুসারে কিছু কিছু বিষয় অবগত হইয়াছেন। হে বনী আদমগণ তোমরা বসিয়া পড়।

অতঃপর তিনি আল্লাহর নাম স্মরণ করিয়া আসমানের দিকে হাত তুলিয়া লোকজনের মনের বাসনা অনুযায়ী প্রত্যেকের সম্মুখে পৃথক পৃথক খাদ্যের তাম্র বরতন রাখিয়া বলিলেন- আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর বান্দাগণ। আল্লাহর নেয়ামত আল্লাহর নাম স্মরণ করিয়া তোমরা খাইতে আরম্ভ কর।
লোকজন দেখিল, তাহাদের মনের বাসনা অনুযায়ী খাদ্য সমূহ তাহাদের সম্মুখে হাজির করা হইয়াছে। আহার সমাপ্ত করিয়া সকলে মিলিয়া হযরত খাজা হারুনীর (রহঃ) পদতলে লুটাইয়া পড়িয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিল। ইহারা পরবর্তী কালে প্রত্যেকেই একেকজন কামেল বোযর্গরূপে পরিগণিত হইয়াছিলেন।

বর্ণিত আছে, যখন হযরত খাজা হারুনী (রহঃ) নামায পড়িতে আরম্ভ করিতেন, তখনই তিনি শুনিতে পাইতেন—হে ওসমান হারুনী (রহঃ)! আমি তোমার নামাযকে পছন্দ এবং কবুল করিয়াছি। তুমি আমার নিকট যাহা চাহিবার তাহা তুমি চাহিয়া লও। তখন খাজা হারুনী (রহঃ) বলিতেন, হে প্রভু! আমি তোমাকে ব্যতীত অন্য কিছুই চাহি না। জবাবে আল্লাহ পাক বলিতেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাৰ মনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিব, তুমি অন্য কিছু চাহিয়া লও তখন থানা হানী (রহঃ) বলিতেন- হে তুমি রাস্লল্লাহ্র (সঃ) গুণাহগার উম্মতগণকে ক্ষমা ও মুক্তি দান কর। জবাবে আল্লাহর পদ হইতে এরশাদ হইত, আচ্ছা হারুন! তোমার উছিলায় আমি ত্রিশ হাজার উম্মতে মোহাম্মদ - বা দিলাম। এইরূপ প্রতি ওয়াক্ত নামাযে তিনি আল্লাহর তরফ হইতে ত্রিশ হাজার করিয়া উম্মতে মোহাম্মদীর (সঃ) গুণাহ মাফ করাইয়াছিলেন। এইভাবে সারা জীবনের নামায তিনি। কোটি কোটি উম্মতে মোহাম্মদী (সঃ) কে তাহইতে মুক্তি করাইয়া লইয়াছিলেন।

বর্ণিত আছে, যে কোন ব্যক্তি তাহার দরবারে আগমন করিতেন কিংবা তাঁহার করুণার দৃষ্টি একবার মাত্র যাহার উপর পতিত হইত তিনিই কাশফ ও কারামতের কইতেন। আর আমাশে মোয়া হইতে তা হস্তাচ্ছারা পর্যন্ত ভার পোষ্টির সমূখে উদ্ভাসিত হইয়া সই। তিনি আল্লাহ পাকের নিগুড়তম রহস্য হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেন। তাহার নিকট কেহ মুরীদ হওয়া মাত্রই তিনি আল্লাহর নেকটা লাভে ধন্য হইতেন। অর্থাৎ রাজা ওসমান হারুনীর (রহঃ) প্রত্যেক মুরীদই, অদ্বিতীয় অলী আল্লাহ ও ৰোয়ৰ্গরূপে গণ্য হইয়াছিলেন। হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) দুনিয়ার নানাস্থানে যোগা মাশায়েখ খুঁজিতে খুঁজিতে অবশেষে খাজা ওসমান হারুনীর (রহঃ) মত ব্যক্তিকে লাভ করিয়াই তাঁহার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ছিলেন । হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) বোখারা হইতে নিরুদিষ্ট হইয়া বিভিন্নস্থানে অবস্থান করিলেন এবং একজন যোগ্য পীরের সন্ধান করিতেছিলেন। তখন ”হারুন” নামক এক স্থানে হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) বাস করিতেন। হইতে ইরাক যাওয়ার পথে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) হযরত খাজা ওসমান হারুনীর (রহঃ) দরবারে হাজির হইলেন। খাজা ওসমান হারুনীর (বহঃ) নিজেই স্বীয় আত্মার আকর্ষণ বলে তাঁহার সন্নিকটে টানিয়া আনিলেন। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) কিছুদিন অবস্থান করিয়াই বুঝিতে পারিলেন- তিনি একজন অসাধারণ ওলী । .

বহুদিন ধরিয়া খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) যেরূপ একজন পীরের সন্ধান করিয়াছিলেন । হযরত খাজা ওসমান হারুনীও (রহঃ) তাঁহার সেই কাম্য পীর। তিনি কিভাবে তাঁহার মুরীদ হইলেন তাহা তিনি নিজেই লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন ।"বড় বড় বোযর্গ ও মাশায়েখে কেরাম হযরত ওসমান হারুনীর (রহঃ) সান্নিধ্যে ছিলেন। এমন সময় আমি তাঁহার দরবারে হাজির হইলাম এবং মুরীদ হওয়ার জন্য আবেদন জানাইলাম। তিনি আমাকে দুই রাকাত নামায় পড়িতে আদেশ দিলেন। নামায পাঠ শেষে তিনি আমাকে কেবলামুখী হইয়া বসিয়া সুরা বাকারা' পড়িতে নির্দেশ দিলেন। আমি অত্যন্ত ভক্তি সহকারে একান্ত মনে তাহা পাঠ করিলাম । অতঃপর তিনি আমাকে বলিলেন ষাট বার সোবহানাল্লাহ' পড়। আমি তাহাও পালন করিলাম। তারপর তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং আমার হাত ধরিয়া আসমানের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, আমি তোমাকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌছাইয়া দিলাম। তারপর তিনি একটি বিশেষ ধরনের টুপি আমার মস্তকে পরাইয়া দিয়া তাহার নিজস্ব কম্বল দ্বারা আমাকে ঢাকিয়া দিয়া বলিলেন- বস, আমি বসিয়া পড়িলাম। তারপর তিনি আমাকে এক হাজার বার সুরা ইখলাস' পাঠ করিতে বলিলেন। আমি তাহাও পাঠ করিলাম। অতঃপর তিনি বলিলেন- যাও! এখন একদিন ও একরাত্রি সাধনা কর। তারপর আবার আসিও। সেই দিনের মত বিষয় লইয়া আমি আস্তানায় ফিরি, আসিলাম। নামায় যেকের আসকার ও মোরাকাবায় একদিন একরাত্রি কাটিয়া গেল। পরদিন ভোর বেলায় আবার তাঁহার খেদমতে গমন করিলাম । তিনি আমাকে রসিতে বলিয়া আসমানের দিকে তাকাইতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- কি দেখিতে পাইতেছ? আমি সবিনয়ে উত্তর করিলাম আরশে মোয়াল্লা পর্যন্ত দেখিতে পাইতেছি। তিনি বলিলেন- এইবার নিচের দিকে তাকাও, আমি তাকাইলাম । বলিলাম, এইবার তাততাচ্ছারা পর্যন্ত দেখিতে পাইতেছি। তিনি বলিলেন- এখনও হয় নাই। আবার এক হাজার বার 'সুরা ইখলাস পাঠ কর। আমি অবনত শিরে সুরা পাঠ করিতে লাগিলাম। সুরা পাঠ শেষে তিনি আমাকে আসমানের দিকে তাকাইতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি দেখিতে পাইতেছে বলিলাম হাজরে আসওয়াদ দেখিতে তারপর তিনি আমাকে চক্ষু বন্দ করিয়া থাকিতে বলিলেন। একটু পর আবার চক্ষু খোলার নির্দেশ দিয়া তাঁহার অঙ্গুলীদ্বয় আমার চোখের সম্মুখে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এখন কি দেখিতে পাইতেছ? আমি উত্তর করিলাম আঠার হাজার আলম নজরে পড়িতেছে। জবাব শুনিয়া তিনি খুব খুশী হইলেন। বলিলেন- যাও, তোমার শেষ হইয়াছে। তারপর একখানি ইটের নিচে রক্ষিত কয়েকটি দীনার উঠাইয়া আমার হাতে তুলিয়া দিয়া তিনি বলিলেন- ইহা দীন দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করিয়া দাও। আমি তাহা সদকা করিয়া সস্থানে ফিরিয়া আসিলাম । হযরত খাজা হারুনী (রহঃ) কর্তৃক বহু ধরনের অসংখ্যা কারামত প্রদর্শিতহইয়াছে । এখানে তাহার অতি সামান্যই উল্লেখ করা হলো। খাজা হারুনী (রহঃ) অপরিমেয় জ্ঞানলিপ্সা ও লোক হেদায়েতের উদ্দেশ্যে জীবনে বহু দেশ ও পবিত্রস্থান ভ্রমণ করিয়াছেন । প্রতিটি স্থানে তাঁহার নিকট অগণিত লোক শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছিল ।অতঃপর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ শেষে জীবনের শেষ প্রান্তে আসিয়া তিনি পবিত্র মক্কা মোয়াযযমায় অবস্থান করেন। তারপর মক্কা মোয়াযযমায় এতেকাফ রত অবস্থায় ছয়শত সতের কিংবা ছয়শত সাত হিজরী সনের ছয়ই শওয়াল তারিখে পরলোক গমন করেন। পবিত্র কা'বাগৃহ এবং জান্নাতুল মোয়াল্লার মধ্যবর্তীস্থানে তাঁহাকে সমাধীস্থ করা হইয়াছিল

চিশতীয়া তরীকাঃ

হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) যে তরীকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন তাহার নাম চিশতীয় তরীকা । তাঁহার সপ্তম ঊর্ধ্বতন পীর খাজা ইসহাক চিশতীর নাম অনুসারেই তরীকার নাম 'চিশতীয়' হইয়াছে।
চিশত একটি গ্রামের নাম । উহা খোরাসানের অন্তর্গত কোন এক স্থানে অবস্থিত। খাজা ইসহাক চিশতী সিরিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সিরিয়া হইতে এই স্থানটিতে আসিয়া তাঁহার আস্তানা গাড়িয়া ছিলেন। এইখানে তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা, ও ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা করেন । ইহা ছাড়াও একে এলাহীর মধু আহরণ করার জন্য দেশ-বিদেশ হইতে তাঁহার বহু ভক্তবৃন্দ এবং আলেমগণ এখানে আগমন করিত । ইহাতে ধীরে ধীরে গ্রামখানি উন্নত ও প্রসিদ্ধ হইয়া উঠিল।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর পীর হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) হযরত মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রহঃ) মস্তকে যেই চতুষ্কোন বিশিষ্ট টুপিটি প্রদান করিয়াছিলেন, ইহার মধ্যে চারিটি অর্থে বিদ্ধমান ছিল। তাঁহার দাদাপীর হাজী শরীফ যিন্দানী কামোল অলী-আল্লাহ ছিলেন। খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) কে খেলাফত প্রদানের সময় এই চতুষ্কোন বিশিষ্ট টুপিটি তাঁহার মস্তকে পরাইয়া দিয়া তিনি বলিয়াছিলেন- বাবা ওসমান! এই টুপিটি আমি তোমাকে দান করিলাম । ইহা চারিকোনা বিশিষ্ট হওয়ার চারটি অর্থ আছে 

১মঃ -তোমাকে পার্থিব জগতের সকল প্রকার মোহ পরিত্যাগ করিতে হইবে কোন অবস্থাতেই লোভ-লালসাকে স্থান দেওয়া চলিবে না। ইহা একটি মারাত্মক রোগ, যাহা অন্তর হইতে এশকে এলাহির আকর্ষণ দূর করিয়া দেয়।

২য় ঃ-খাহেশাতে নফছ বা প্রবৃত্তির তাড়নাকে একেবারে দূর করিয়া দিতে হইবে। মন যাহা চায় তাহাই যদি কর, তবে মা'রেফাতের পথে অগ্রসর হওয়া দুঃসাধ্য হইবে। জৈব শক্তি মানুষকে পাপের পথে পরিচালনা করে। কাজেই শক্তিকে সর্বদাই দমন করার চেষ্টা করিবে ।

তয়ঃ স্বল্পাহার ও কম নিদ্রার অভ্যাস করিতে হইবে। অতিরিক্ত ভোজন ও নিদ্রাদিলকে গাফেল করিয়া তোলে। এবাদতে অলসতা সৃষ্টি হয়। অন্তর খোদা বিমুখ হয়।

হয়। ৪র্থ :- দিল হইতে পারলৌকিক শান্তির আশা বিসর্জন দিতে হইবে। বেহেশতের আশায় কিংবা দোজখের ভয়ে যাহারা এবাদত করে তাহারা এশকে এলাহীর স্বাদ কখনও পায় নাই। ইহা মারেফাতের অতি নিম্নস্তর। কাজেই এই স্তর অতিক্রম করিয়া খোদার প্রেমের আস্বাদ পাইতে চেষ্টা করিবে।

তিনি আরও বলিলেন, তোমার পর তোমার মুরীদানের যাহার মধ্যে এই চারিটিগুন দেখিতে পাইতে সেই উপযুক্ত। অনুপযুক্ত লোককে উহা করানো নিতান্ত অন্যায়।
খাজা হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) পীরের এই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন। একাধারে তিন বৎসর তিনি নির্জন সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। তারপর পীরে কামেলের অনুমতিক্রমে তিনি সফর আর করেন। পাজা (রহঃ) কে মুরীদ করিয়া তাহাকে সহ তিনি মক্কা মুয়াযযমায় হজ্জ্ব করিতে আসেন তারপর মদীনা শরীফ গমন করেন। মদীনা শরীফ রাসূলে করীম (স) এর রওজা শরীফ যিয়ারত করিয়া তিনি বদখশানের পথে পা বাড়ান। তথায় বহু ওলামায়ে কেরাম ও বোযর্গ লোকের সহিত তাহার সাক্ষাৎ ঘটে। তারপর আবার নূতন স্থান সফর করেন। এইভাবে একাধারে দশ বৎসর সফর করিয়া তিনি বাগদাদ আগমন এখন তিনি খুবই ক্লান্ত দেহহইয়া পড়িয়াছিলেন। তাই কিছুদিন বাগদাদে বিশ্রাম গ্রহণ এ নিয়া তিনি আবার সফর শুরু করিলেন।

খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) অন্যান্য মুরীদানের চাইতে মুরীদ খাজা মুঈনুদ্দীন জগতী (রহঃ) কে বেশ মুহব্বত করিতে ও রোয়ণী ছিল উচ্চ মালের। একবার তিনি খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর সাথে দেখা করিবার জন্য তাঁহার আস্তানায় গমন করেন। পথে একস্থানে আগুনের অভাব দেখা দেওয়ায় তিনি ফখরুদ্দীন নামক একজন খাদেমকে নিকটস্থ এক পল্লীতে প্রেরণ করেন। তথাকার পল্লীবাসীরা ছিল অগ্নি উপাসক।তাহারা একটি বিরাট অগ্নিকাণ্ড জ্বালাইয়া রখিয়াছিল। ফখরুদ্দীন তাহাদের নিকট অগ্নি চাহিলে তাহারা উহা দিতে অস্বীকার করিল। বাধ্য হইয়া তিনি ফিরিয়া আসিলেন এবং খাজা ওসমান হারুনী-এর (রহঃ) নিকট সকল ঘটনা ব্যক্ত করিলেন ।

খাদেমের কথা শ্রবন করিয়া খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) নিজেই সেখানে আগমন করিলেন। অতঃপর বলিলেন- দেখ! তোমরা অগ্নিপূজা পরিত্যাগ কর। উহা পূজা করিলে তোমাদের কোন লাভই হইবে না। সামান্য পানিতেই যাহা নিভিয়া যায়, তাহার স্থায়িত্ব কোথায়। কিন্তু পূজারীরা উহা মানিতে রাজি হইল না। তাহারা অগ্নির দাহন শক্তির সমান অন্য কোন শক্তি নাই। বিন্দু পরিমাণ অগ্নি মুহূর্তের মধ্যে বিরাটাকার ধারণ করিয়া প্রলয়ংকরী ঘটনা ঘটাইতে পারে। অতএব উহার পূজা না করা নিতান্ত নির্বোদের কাজ। খাজা সাহেব বলিলেন- আচ্ছা ! তোমরা পর্যন্ত উহাকে পূজা করিয়া আসিতেছ। কেহ উহার মধ্যে একখানা হাত প্রবেশ করাইয়া দেখ তো উহা তোমাদিগকে জ্বালায় কিনা? লোকগুলি বলিল অগ্নির স্বভাবই জ্বালানো। অতএব অগ্নি তো জ্বালাবেই। খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) অতঃপর নিজের পাদুকাখানী অগ্নি কুণ্ডলীর মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিলেন। আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা! পাদুকাখানার বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হইল না। আগুন তাহা স্পর্শই করিল না। ইহা দেখিয়া অগ্নি পূজারীরা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল । তাহারা তওবা করিয়া মুসলমান হইয়া গেল ।।

খাজা ওসমান হারুনীর (রহঃ) বোযগীর বর্ণনা দিতে গিয়ে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) বলিয়াছেন- তিনি ছিলেন মস্তবড় একজন আবেদ। তাঁহার আহার ছিল কম, নিদ্রা ছিল অতি সামান্য। বেশীর ভাগ সময় তিনি এবাদত ও রিয়াজাতে লিপ্ত থাকিতেন। দিবা ও রাত্রিতে তিনি দুইবার কোরআন শরীফ খতম করিতেন। দেশ আলোকে আলোকিত ছিল। যে-ই তাহার সান্নিধ্যে আসিত সে-ই ধন্য হইয়া যাইত । তাঁহার রুহানী ফায়েজের প্রভাবে অতি পাপী ব্যক্তিও পাপের কালিমা হইতে মুক্তিলাভ করিত ।মুঈনুদ্দীন চিশতী বলিয়াছেন-“হযরত মোরশেদের একজন মুরীদ ইন্তেকাল করিয়াছিলেন তাঁহার জানাযায় শরীক হইয়াছিলাম। লোকজন তাঁহার দাফন শেষ করিয়া চলিয়া গেল। আমি ক্ষণিকের জন্য দাঁড়াইয়া রহিলাম । অন্তদৃষ্টি দ্বারা আমি দেখিলাম, আযাবের ফেরেশতারা ভীষণ রুদ্র মূর্তিতে তাহার কবরে প্রবেশ করিয়াছে। তাঁহারা তাহাকে শাস্তি দেবার জন্য উদ্যত হইল। এমন সময় হঠাৎ কোথা হইতে খাজা ওসমান হারুনী (রহঃ) আগমন করিলেন। ফেরেশতাগণকে - তিনি বলিলেন, এই লোকটি আমার মুরীদ ইহাকে শাস্তি দিও না। ফেরেশতাগণ বলিলেন, এই ব্যক্তি আপনার মুরীদ ছিল না। সে আল্লাহর হুকুমের বরখেলাপ কাজ করিত। তিনি বলিলেন, সে যাহাই হউক এই ব্যক্তি নিজকে আমার মুরীদ বলিয়া বিশ্বাস করিত। অতএব সে ক্ষমা পাওয়ার জন্য উপযুক্ত, সাথে সাথে সেই মুহূর্তেই আল্লাহর তরফ হইতে আদেশ হইল-যাও! উহাকে মাফ করিয়া দিলাম।”


হিন্দুস্তানে ইসলামের বিজয় পতাকা ঃ
হিন্দুস্তানে মুসলমানদের প্রথম বিজয় পতাকা উড্ডীন হয় ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে। সিন্ধুর ব্রাহ্মণরাজা দাহিরকে পরাস্ত করিয়া মুহাম্মদ বিন কাসিম সর্বপ্রথম এখানে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম করেন। শস্য-শ্যামল, সুজলা, সুফলা বলিয়া মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর হইতে আরব দেশ হইতে মুসলমানগণ এখানে আসিয়া বসবাস করিতে থাকেন । কিন্তু তাহাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আর তাহাদের বসবাস সিন্ধু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে মুসলমানদের কৃষি, সভ্যতা ও আদর্শ শুধু সিন্ধু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দুস্তানের অন্যান্য অংশে উহা কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই ।

৯৭৬ খ্রীস্টাব্দে গজনীর বাদশাহ সবুক্তগীন পাঞ্জাবের রাজা জয়পালের সহিত যুদ্ধ করেন । ইহার পর ইহাতে মুসলমানগণ হিন্দুস্তানের উপর একের পর এক আক্রমণ পরিচালনা করিতে থাকেন। সুলতান মাহমুদ গজনবী কয়েকবারই হিন্দুস্তান আক্রমণ করেন। কিন্তু এখানে স্থায়ীভবে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি কোন সময় চিন্তা করেন নাই ।সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর ঘোরী সম্প্রদায় হিন্দুস্তান আক্রমণে নতুন পদক্ষেপ নেন এবং তাঁহারাই এইখানে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম করার জন্য উদ্যোগী হয়। মূলত ইহাদের সময় হইতেই হিন্দুস্তানে সত্যিকার ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।সিন্ধু বিজয়ের সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে যে সকল ধর্ম-প্রচারক হিন্দুস্তানে আগমন করিয়াছিলেন। এই সকল ধর্ম প্রচারকগণ সিন্ধু, পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও ভারতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করিয়া ইসলাম ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন। তাহাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেক কামেল ওলীও এইসব এলাকায় পয়দা হইয়াছেন। তবে ঐতিহাসিকগণ তাঁহাদের কাহারও নাম উল্লেখ করেন নাই । ফলে তাঁহাদের সম্পর্কে
আমরা কোন কিছুই জানিতে পারি নাই। তাছাড়া তাঁহাদের প্রচারকার্য শুধু সিন্ধু এবং নির্দিষ্ট কিছু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । মূলতঃ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীই (রহঃ) একমাত্র ব্যক্তি যিনি হিন্দুস্তানে ইসলাম ধর্ম প্রচারকার্য চালাইয়া ছিলেন ।

তৎকালে হিন্দুস্তানে ধর্মীয় অবস্থা ঃ

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) পূজার প্রচলন ছিল। ব্রাহ্মণ পূজারীরা মন্দিরে মন্দিরে ঠাকুর দেবতার পূজা করিত। ইহা ছাড়াও বড় বৃক্ষ, জানোয়ার কিংবা যে কোন আশ্চর্য বস্তু দেখিলেই তাহারা উহার পূজা করিত। তাহাদের ধারণা ছিল যাহারা অসীম শক্তির অধিকারী তাহারাই প্রকৃত খোদা। স্বয়ং ভগবান এক এক সময় এক এক আকৃতিতে মানুষের কাছে আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকেন। ধর্ম-যাজক ব্রাহ্মণরাই ছিল পূজার একমাত্র অধিকারী! পূজা ব্যবসায়ের উপরই তাহাদের জীবিকা নির্বাহ করিত। অর্থাৎ পূজা অর্চনা ব্যবসার উপরই তাহারা জীবিকা অর্জন করিত। সুতরাং এই ব্যবসা যাহাতে টিকিয়া থাকে তাহার জন্য ছিল তাহাদের জোরদার প্রচেষ্টা। তাহারা সরলপ্রাণ হিন্দুদের নিকট পূজা অর্চনার মহাত্ম বর্ণনা করিত এবং উহাদের শক্তি সম্পর্কে আজব মনগড়া কাহিনী ব্যক্ত করিয়া তাহাদিগকে ভুলাইয়া রাখিত। সিন্ধু বিজয়ের ফলে মুসলিম সভ্যতা যতটুকু প্রসার লাভ করিয়াছিল, কালের প্রবাহে তাহাও আর অবশিষ্ট রহিল না। ক্রমান্বয়ে উহা প্রায় বিলীন হইয়া আসিয়াছিল । হিন্দুস্তানের এই তমশাছন্ন করুণ অবস্থা দেখিয়া অতিশয় আশ্চর্যান্বিত ভাবনাপন্ন ও ব্যথিত হইয়া উঠিলেন ।

পুণ্যভূমি আজমীরে আগমন ঃ
খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) দিল্লীতে কিছুকাল অবস্থান করিয়া ইসলাম প্রচার করিলেন। অতঃপর দিল্লীতে যখন অগনিত লোক ইসলাম গ্রহণ করিল তখন তিনি স্বীয় মুরীদ খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহঃ) কে দিল্লীতে অবস্থান করার নির্দেশ দিয়া তিনি আজমীর গমন করিলেন ।খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) যখন পুণ্যভূমি আজমীরে আগমন করেন তখন আজীমরের শাসনকর্তা ছিল পৃথ্বিরায়। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) আজমীর আগমন করিয়া সর্বপ্রথম যে স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন উহা ছিল রাজার উষ্ট্র চারণ ভূমি । রাজার রাখালরা নিত্যকার মত যখন উচারণ ভূমিতে উষ্ট্রগুলি লইয়া আসিল তখন তাহারা দেখিল, একজন মুসলিম অলী সেখানে বসিয়া তাছবীহ পাঠ করিতেছেন। তাহারা বিরক্ত হইয়া বলিল- দেখুন, এখানে রাজার উষ্ট্র থাকে । আপনি অনুগ্রহণ করিয়া এই স্থান হইতে অন্যত্র চলিয়া যান।খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) বলিলেন, এটাতো বিরাট ময়দান, এখানে উষ্ট্রের থাকিতে কোন অসুবিধা হইবে না। আমাকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করিতে দাও। কিন্তু রাখাললেরা ভীষণ চটিয়া তাঁহাকে চলিয়া যাইতে বলিল । ইহাতে খাজা সাহেব বলিলেন, “আচ্ছা! আমি চলিয়া যাইতেছি। রাজার উদ্ভই এখানে শয়ন করিয়া থাকুক।” অতঃপর তিনি চলিয়া গেলেন । সন্ধ্যাবেলা নিশ্চিন্ত মনে উটগুলি রাখিয়া রাকালরা চলিয়া গেল । কিন্তু সকালবেলা তাহারা আসিয়া দেখিল, উটের চামড়া মাটির সাথে এমন ভাবে যুক্ত হইয়া আছে যে,

উহা ছাড়াইয়া লওয়ার কোন উপায় নাই। রাখালরা ইহাতে ভয় পাইয়া সকল ঘটনা রাজার কর্ণগোচর করিল।রাজা তিনি নিশ্চয়ই কোন বড় অলী-আল্লাহ হইবেন। তোমরা শীঘ্রই গিয়া তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলো । রাজার কথা শুনিয়া রাখারা তখনই খাজা সাহেবের খেদমতে গমন করিল। তাহারা দেখিল, তিনি নিবিষ্ট মনে তাছবীহ পাঠ করিতেছেন। তাহার পবিত্র মুখমণ্ডল হইতে স্বৰ্গীয় দীপ্তি প্রকাশ পাইতেছে। তাহারা খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে লুটাইয়া পড়িয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া উষ্ট্রগুলির মুক্তি কামনা করিল । তাহাদের সকাতর প্রার্থনা শুনিয়া খাজা সাহেব বলিলেন, “যাও! যে আল্লাহর আদেশে মাটির সহিত আটকাইয়া গিয়াছে, সেই আল্লাহর হুকুমে উহা মুক্তি পাইবে ।”খাজা কথা শুনিয়া রাখালেরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁহাকে কুর্নিশ করিয়া যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, উটগুলি পূর্বের মত স্বাভাবিক ভাবে যথাস্থানেদাঁড়াইয়া রহিয়াছে ।

আনা সাগরের তীরেঃ
খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) উষ্ট্র চারণভূমি হইতে আসিয়া আনা সাগর হৃদের তীরে গাড়িলেন। তাঁহার সঙ্গে ছিলেন একদল মুসলিম ফকীর। তাঁহারা খাজা সাহেবের সাহচর্যে থাকিয়া তাহারা মারেফাত শিক্ষা করিতেন এবং তাঁহার নির্দেশ মোতাবেক মানুষের কাছে ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম বর্ণনা করিতেন । আনা সাগরের দুই তীরে বহু মন্দির বিদ্যমান ছিল । এই মন্দিরগুলির মধ্যে একটি ছিল বড়। দেশের নামকরা ব্রাহ্মণ পূজারীরা এই মন্দিরে পূজা করিত। স্বয়ং রাজাও মাঝে মাঝে এই মন্দিরে আগমন করিতেন এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম ও দক্ষিণা দান করিতেন। কথিত আছে এই মন্দিরে রোজ তিন মণ তেল খরচ হইত । তিনশত পূজারী এখানে পূজা করিত।

বহুকাল যাবত মন্দিরের পূজাপার্বণের কাজ নির্বিঘ্নে চলিয়া আসিতে ছিল । কিন্তু একদা হঠাৎ পূজারীরা সান্ধ্য আইনের সময় শুনিতে পাইল, কে যেন উচ্চ শব্দে, অথচা মধুর স্বরে “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার” বলিয়া ডাক দিতেছেন। আজানের 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি শ্রবণ করিয়া ব্রাহ্মণগণ মন্ত্রপাঠ ভুলিয়া গেল । তাহাদেরপূজার কার্যে বাধার সৃষ্টি হইতে লাগিল। তাহারা বাহিরে আসিয়া দেখিল, একদল মুসলমান ফকীর সারি বাঁধিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং তাহাদের সম্মুখে দলের প্রধান ব্যক্তি দণ্ডায়মান হইয়া একাগ্রচিত্তে অপূর্ব সুর ধ্বনি সহকারে কি যেন আবৃতি করিয়া বিশ্ব নিয়ন্তার উদ্দেশ্যে সমবেত ভাবে উপাসনা ও প্রার্থনা করিতেছে।

বিশ্ব-নিয়ন্তার কাছে আত্মনিবেদনের এই অপূর্বরীতিটি অনেকের কাছে ভাল মন্দিরের সম্মুখে আসিয়া আজান দেওয়া, প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় জিকিরের শব্দে তাহাদের মনে এক বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হইল। কিন্তু ফকীরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনিয়া তাঁহাদের সম্মুখে আসিয়া কিছু বলিবার মত শক্তি ও সাহস তাহাদের হইল না। অতএব তাহারা বাধ্য হইয়া রাজ দরবারে গিয়া অভিযোগ উত্থাপন করিল। মহারাজ একদল মুসলমান ফকীর আমাদের মন্দিরের নিকট আসিয়া উচ্চস্বরে আজান দেয় এবং নামাজ পাঠ করে। তাঁহাদের সেই আজান ও জিকিরের শব্দ আমাদের পূজা অর্চনার কাজে বিঘ্ন ঘটাতেছে। অনতিবিলম্বে যদি তাঁহাদিগকে এই স্থান হইতে বিতারিত করা না হয় তবে শীঘ্রই পূজা অর্চনার কাজ দিয়া আমাদিগকে এই স্থান ত্যাগ করিতে হইবে।

মুসলিম বিদ্বেষী রাজা পৃথ্বিরায় তাহাদের এই অভিযোগ শ্রবণ করিয়া ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করিল। তিনি তৎক্ষণাৎ একদল সৈন্য প্রেরণ করিয়া আদেশ করিলেন-যেমন করিয়া পার এই মুসলিম ফকীর দলকে দেশত্যাগ করিতে বাধ্য কর। তাহারা আমাদের খুবই বিরক্ত করিতেছে। ধর্মের ছদ্মাবরনো তাঁহারা রাজ্যের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিতে চায়। নতুবা মন্দিরের নিকট তাঁহারা আজান দিয়া নামায পড়িবার দুঃসাহস দেখাইল কি করিয়া? যাও! এই মুহূর্তে তাহাদিগকে আনা সাগরের তীর হইতে তাড়াইয়া দাও।
রাজা পৃথিরায়ের আদেশে একদল সৈন্য রাজা সাহেবের আস্তানার সম্মুখে আসিয়া খাজা সাহেব ও তাঁহার সঙ্গীদের প্রতি নানা অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল। বলিল— এই মুহূর্তে তোমরা এইস্থান পরিত্যাগ কর। নতুবা তোমাদিগকে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দেওয়া হইবে। খাজা সাহেব এতক্ষণ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাছবীহ পাঠ করিতে ছিলেন। সৈন্যদের অশ্রাব্য কথা শুনিয়া তাহাদের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। তাঁহার সে দৃষ্টির তেজ এত তীব্র ছিল যে তাহারা সহসা হতভম্ব হইয়া পড়িল। তিনি সৈন্যদের বলিলেন— তোমরা এইস্থান হইতে চলিয়া যাও। সম্মুখে আর এক পা-ও অগ্রসর না, অন্যথায় তোমাদের বিপদ ঘটিবে
কিন্তু সৈন্যরা তাঁহার কথায় গুরুত্ব না দিয়া জোরপূর্বক তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে হইল । নিরূপায় হইয়া খাজা সাহেব একমুঠি ধুলি লইয়া তাহাদের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। সেই ধুলি সৈন্যদের দেহ স্পর্শ করিবার সাথে সাথে কেহ অন্ধ, কেহ বধির, কেহ খঞ্জ এবং কেহ পাগল হইয়া চিৎকার করিতে লাগিল। তথায় যাহারা তামাসা দেখিবার জন্য সমবেত হইয়াছিল তাহারা এইরূপ দৃশ্য দেখিয়া দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হইয়া যে যেই দিকে পারিল ছুটিয়া পালাইল ।

আনা সাগরে অত্যাশ্চর্য ঘটনাঃ
রাজা পৃথ্বিরায় যখন জানিতে পারিলেন সে খাজা সাহেবকে তাড়াইতে যাইয়া রামদেও নিজেই মুসলমান হইয়াছে এবং মুহাম্মদ সা'দী নাম ধারণ করিয়াছে। এইরূপ ঘটনা শুনিয়া রাজা পৃথ্বিরায় রাগে, দুঃখে ও ক্ষোভে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িলেন।পৃথ্বিরায়ের মাতা তাহাকে পরামর্শ দিয়া বলিলেন, এই মুসলমান ফকীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে যাইও না। তিনি যে একজন সিদ্ধপুরুষ তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।তাঁহার রোষদৃষ্টিতে পড়িলে তোমার রাজ্য, ধন দৌলত সব কিছুই বিলীন হইয়া যাইবে। যদি পার তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা কর। তাঁহাকে উত্যক্ত করিয়া খামখা নিজের বিপদ ডাকিয়া আনিও না । মাতার আদেশে রাজা পৃথ্বিরায় তখনকার মত শান্ত হইলেন। কিন্তু আবার এক বিপদ দেখা দিল।আনা সাগরের পানি শুধুমাত্র মন্দিরের পুরোহিত ও উচ্চজাত হিন্দুরা ব্যবহার করিতে পারিত। নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু অথবা অন্য ধর্মের লোকের জন্য উহার পানি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ছিল ।

একদা খাজা সাহেবের একজন অনুচর আনা সাগরে ওযু করিতে গিয়াছিলেন। কিন্তু যেইমাত্র তিনি ওযু করিতে ঘাটে নামিলেন, অমনি একদল ব্রাহ্মণ পূজারী সেখানে আসিয়া তাহাকে বাধা দিল। ব্রাহ্মণগণ তাহাকে ম্লেচ্ছ বলিয়া গালি দিয়া জোরপূর্বক তাড়াইয়া দিল । অপমানাহত শিষ্য খাজা সাহেবের নিকট হাজির হইয়া সকল কথা ব্যক্ত করিলেন। খাজা সাহেব ভক্ত প্রাণ মুহাম্মদ সা'দীকে ডাকিয়া বলিলেন- যাও, বাছা! আনা সাগর হইতে এক ঘটি পানি নিয়া আস। আদেশ পাইয়া মুহাম্মদ সা'দী পানি আনিতে গেলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার! পানিতে ঘটি রাখিতেই আনা সাগরের সমস্ত পানি শুকাইয়া গেল। শুধু তাহাই নহে সমস্ত আজমীরের পানি মুহূর্তে শুকাইয়া গেল। কোথাও একবিন্দু পানির চিহ্ন রহিল না। ব্রাহ্মণেরা পানি নিতে আসিয়া অবাক ও হতবাক হইয়া গেল- একি বিস্ময়কর ব্যাপার! ক্ষণিক পূর্বে যেখানে অগাধ জলরাশি বিদ্যমান ছিল। সেখানে এখন এক ফোটা পানিও নাই। পানির জন্য দেশ জুড়িয়া হাহাকার পড়িয়া গেল। পানির তৃষ্ণায় লোকেরা ছটফট করিতে লাগিল!

রাজা পৃথ্বিরায় বুঝিতে পারিলেন মুসলমান ফকীরের শীষ্যকে ওযুর পানি দেওয়ায় এই অঘটন ঘটিয়াছে। উপায়ন্তর না দেখিয়া রাজা পৃথ্বিরায় ব্রাহ্মণদিগয়ে আদেশ করিলেন- যাও, যে ভাবেই পার মুসলিম ফকীরকে খুশী করিতে চেষ্টা কর। অন্যথায় এই বিপদ হইতে রক্ষা পাওয়ার অন্য কোনই উপায় নাই । রাজাদেশ শুনিয়া ব্রাহ্মণগণ ভীষণ সমস্যায় এবং লজ্জায় পড়িল। শেষ পর্যন্ত একজন মুসলমানের নিকট তাহাদের ক্ষমা প্রার্থনা করিতে হইবে। অথচ ক্ষমা ভিক্ষা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না। তাহারা নির্বাক ও নত মস্তকে খাজা সাহেবের দরবারের অগ্রসর হইতে লাগিল ।

এদিকে পানির অভাবে অধীর আগ্রহে লোকেরা দলে দলে খাজা সাহেবের দরবারে উপস্থিত হইয়া পানির জন্য আকুল আবেদন জানাইতে লাগিল । খাজা সাহেব দেখিলেন, এই সরলপ্রাণ মানুষগুলির কোন দোষ নাই। ব্রাহ্মণ পূজারীরাই শুধু তাহাদিকে মূর্তিপূজার জালে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। তিনি লোকদিগকে ইসলামের আহ্বান জানালেন। অতঃপর খাজা সাহেব সা'দীকে বলিলেন যাও! ঘটির পানি আনা সাগরে রাখিয়া আস! নির্দেশ মোতাবেক মুহাম্মদ সা'দী ঘটির পানি লইয়া আনা সাগরে গেলেন। কিন্তু আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা! ঘটির পানি আনা সাগরে ফেলিয়া দিতেই আনা সাগর পানিতে ভরিয়া গেল। খাজা সাহেব উপস্থিত লোকগণকে বলিলেন, “যাও! এবার আর পানির অভাব হইবে না। আগের মতই সব জায়গায় পানি পাইবে।” এই ঘটনার পর কিছুদিনের মধ্যেই বহু হিন্দু খাজা সাহেবের হাতে ইসলাম ধর্ম। গ্রহণ করিয়া মুসলমান হইল । কাহারও মনে আর কোন সন্দেহ রহিলনা যে, খাজা একজন অলৌকিক সম্পন্ন মহা পুরুষ। হিন্দু ধর্মের অসারতা সম্বন্ধে অনেকের মনের দোলা লাগিল। বহু লোক যেমন তাঁহার নিকট ইসলাম গ্রহণ করিল। তেমনি অনেকেই তাঁহার নিকট মারেফাতেও দীক্ষা গ্রহণ করিল ।

অজয় পালের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ঃ

হিন্দুরা যেই ভাবে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিতেছে তাহাতে অদূর ভবিষ্যতে হিন্দু ধর্ম টিকাইয়া রাখা দায় হইবে। রাজা পৃথ্বিরায় এই ভাবনায় অস্থির হইয়া পড়িলেন। মুসলিম ফকীরের বিরুদ্ধে কিছুই করা যায় না। সৈন্যবল, অস্ত্রবল সবই তাঁহার কাছে নিম্ফল । তাঁহার অলৌকিক ক্ষমতার নিকট কোন শক্তিই টিকিয়া থাকিতে পারে না। তিনি পারিষদবর্গকে নিয়া এক জরুরী পরামর্শ সভায় বসিয়া বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করিলেন। কিন্তু কেহই ইহার প্রতিবিধান খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিল না ।
রাজা পৃথ্বিরায়ের দরবারে একজন বিচক্ষণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিল । সবাইকে নীরব থাকিতে দেখিয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বলিল- আমার মনে হয় মুসলমান একজন প্রখ্যাত ঐন্দ্রজালিক । যাদু বিদ্যার সাহায্যেই হয়ত তিনি এইরূপ অসাধ্য সাধন করিয়া থাকেন । অতএব তাঁহাকে হার মানাইতে হইলে অজয় পালকে আহ্বান করুন। অজয় পাল যোগী সন্যাসী এবং যাদু বিদ্যায় খুবই পারদর্শী। তিনি নিশ্চয়ই মুসলিম ফকীরকে এদেশ হইতে তাড়াইতে পারিবেন।

রাজা পৃথ্বিরায় ইহাতে খুব আশ্বস্ত হইতে না পারিলেও পারিষদবর্গের সমর্থনে। অজয় পালকে রাজ দরবারে তলব করিলেন। তলব পাইয়া অজয় পাল যথাসময় রাজ দরবারে উপস্থিত হইল । পৃথিরায় তাহাকে বলিলেন, মুসলিম ফকীরকে তাড়াইতে পারিলে বিশেষ রাজকীয় পুরস্কার দেওয়া হইবে।
অজয় পাল যাদু জোরে অজগর তৈয়ার করিতে পারিত এবং গোলাকার অগ্নিচক্র সৃষ্টি করিয়া উহার মধ্যে বিপক্ষকে আটক করিয়া রাখিত। খাজা সাহেবকে ভয় দেখাইবার জন্য অজয় পাল অজগর বানাইয়া ছাড়িয়া দিল। তারপর যাদু-বান হানিয়া আকাশে অগ্নিচক্র সৃষ্টি করিল। সমস্ত আকাশ ধুয়ায় আচ্ছন্ন হইয়া গেল । ইহা দেখিয়া খাজা সাহেব নিজের এবং তাঁহার সঙ্গীদের চতুস্পার্শ্বে একটি গোলাকার রেখা অঙ্কন করিয়া উহার মধ্যে নামায পাঠ করিতে লাগিলেন। নামায শেষে তিনি একমুঠি ধুলি ফুঁক দিয়া অজয় পাল এবং তাহার সঙ্গীদের দিকে নিক্ষেপ করিলেন । অজয় পাল আর সম্মুখে এক পা-ও অগ্রসর হইতে পারিল না। খাজা সাহেবকে ধরা তো দূরের কথা তাঁহার অঙ্কিত রেখার মধ্যেই তাহারা প্রবেশ করিতে পারিল না। তাহার অজগর বাহিরে থাকিয়াই তর্জন গর্জন করিতে লাগিল । অগ্নিকুণ্ডলী আকাশেই থাকিয়া গেল। অজয় পাল আরও যাদু বিদ্যা প্রয়োগ করিল, কিন্তু খোদার মহিমায় উহা ব্যর্থ হইল ।

অজয় পালের পরাজয় ছিল ইহাই প্রথম । অজয় পাল বুঝিতে পারিল এই মুসলিম ফকীর নিশ্চয়ই কোন সিদ্ধ পুরুষ হইবেন। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে ইনি অসাধ্য সাধন করিতে পারেন। খাজা সাহেবের ভয়ে অজয় পাল তাহার সঙ্গী সাথীদের লইয়া যাদুর চামড়ায় চাপিয়ে আকাশে উড়িয়া বাহির হইতে চাহিল । তখন খাজা সাহেব তাহার পায়ের একখানা খড়ম ছুড়িয়া দিলেন অজয় পালের উড়ন্ত আসনের খড়ম খানা উড়িয়া গিয়া অজয় পালের মাথার উপর এলোপাথাড়ি ভাবে পিটাইতে পিটাইতে তাহাকে খাজা সাহেবের দরবারে নামাইয়া আনিল । অজয় পাল অনুতপ্ত হইয়া খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে লুটাইয়া পড়িল । তিনি তাহাকে মাফ করিয়া দিলেন। অজয় পাল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া মুসলমান হইল । তাহার সঙ্গীরাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিল, খাজা সাহেব অজয় পালের নতুন নাম রাখিলেন আবদুল্লাহ বিয়াবাণী ।

মুহাম্মদ ঘোরী ঃ
গজনী বংশের পতনের পর ঘোরী বংশটি ক্রমোন্নতি লাভ করিতে থাকে। ঘোরী বংশের যুবক শেহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরী অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন। মুহাম্মদ ঘোরীর শক্তি দেখিয়া হিন্দুস্তানের রাজপুত রাজন্যবর্গ শঙ্কিত হইয়া পড়িল। রাজপুত রাজাদের মধ্যে রাজা পৃথ্বিরায়ই ছিল সব চাইতে প্রভাবশালী। তিনি হিন্দুস্তানের সকল রাজপুত রাজাদের সংঘবদ্ধ করিয়া ফেলিলেন। স্থির হইলঃ হিন্দুস্তানের যে কোন রাজ্য আক্রান্ত হইলে একযোগে শত্রু পক্ষকে বাধা দিবে। শেহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরী তাহাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিতে পারিয়াও সুযোগ বুঝিয়া একদিন হিন্দুস্তান আক্রমণ করিলেন। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হইল । মুহাম্মদ ঘোরী প্রচণ্ড বিক্রমের সহিত যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু রাজপুত রাজাদের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে তিনি টিকিয়া থাকিতে পারিলেন না । যুদ্ধে অগণিত সৈন্য হারাইয়া শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করিয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেন ।


Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!