মিথ্যার কুফল - The evil of lies

Muhammad Jamal Uddin
0

 

মিথ্যার কুফল  - The evil of lies


মিথ্যার কুফল ঃ

‘মিথ্যা বলা মহাপাপ।” কথাটি প্রত্যেক ধর্মেই স্বীকৃত। বিশেষত ইসলামে এটাকে সকল পাপের মূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিথ্যাই মানুষকে পাপ ও অপরাধের প্রতি উৎসাহ যোগায়। একটি মিথ্যাকে চাপা দিতে অসংখ্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। মূলত মিথ্যার উপর ভরসা করেই মানুষ অপরাধ করার সাহস পায়, মিথ্যাবাদীকে কেউ পছন্দ করে না। এমনকি অতি আপনজনও। মহান দয়াবান আল্লাহও তাদের অভিশাপ করেন, পবিত্র ক্বোরআনে বলা হয়েছে-

لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ

তরজমাঃ মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ।

মিথ্যা মানুষকে জাহান্নামী বানিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِيَّاكُمْ وَالْكِذَبَ فَإِنَّ الْكِذَبَ يَهْدِى إِلَى الْفُجُوْرِ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِى إِلَى النَّارِ وَمَا يَزَالُ الرُّجُلُ يَكْذِبُ وَتَتَحَرَّى الْكِذَبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِندَ اللهِ كَذَّابًا

অর্থাৎ তোমরা মিথ্যাচার হতে বেঁচে থাকো। মিথ্যা পাপাচারের পথ দেখায় আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে, আল্লাহ্র দরবারে তাকে বড় মিথ্যুক বলে লিখা হয়।

মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৪১২) মিথ্যা কত বড় জঘন্য ও নিকৃষ্ট, তা রাসুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর একটি হাদীস শরীফে পরিস্ফূটিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِذَا كَذَبَ الْعَبْدُ تَبَاعَدَ عَنْهُ الْمَلَكَ مِيْلاً مِنْ نَتَيْنِ مَا جَاءَ بِهِ অর্থাৎ যখন মিথ্যা বলে, তখন (তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত) ফেরেশতা মিথ্যার দুর্গন্ধের কারণে এক মাইল দূরে চলে যায়। অর্থাৎ এত বেশী দূর্গন্ধময় যে, যার দুর্গন্ধ এক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

[প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৪১৩]


মিথ্যা কোন প্রকৃত মু'মিনের স্বভাব হতে পারে না। যিনি মু'মিন তিনি সত্যবাদী। সত্য আর মিথ্যা দু'টি বিপরীত ধর্মী জিনিস। এ দু'টি কখনো এক ব্যক্তির মাঝে সন্নিবিষ্ট হতে পারে না। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-

ايَكُونُ لِلْمُؤْمِنِ جَبَانًا قَالَ نَعَمُ - فَقِيلَ لَهُ اَيَكُونُ الْمُؤْمِنُ بَخِيْلاً قَالَ نَعَمُ فَقِيلَ لَهُ

اَيَكُونُ الْمُؤْمِنُ كَذَّابًا قَالَ لَا

অর্থাৎ ঈমানদার কি ভীরু হতে পারে? রাসুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। তাঁকে আরো জিজ্ঞাসা করা হলো, ঈমানদার কি কৃপণ হতে পারে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হলো, ঈমানদার কি মিথ্যাবাদী হতে পারে? তিনি বললেন, “না”। [মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৪১৪।

অর্থাৎ ভীরুতা ও কার্পণ্য ঈমান বিরোধী স্বভাব নয়। কোন মু'মিনের মধ্যে তা সংক্রমিত হতে পারে। ফলে তাকে কাপুরুষ ও কৃপণ বলা যায়। কিন্তু কোন মু'মিনের মধ্যে মিথ্যা বলার দোষ থাকতে পারে না। কারণ, প্রত্যেক মুসলমান জন্মগতভাবে সত্যবাদিতার উপর জন্ম লাভ করে। সমাজে এমন কিছু লোক দেখা যায়, যারা নিজেদেরকে বিজ্ঞ, জ্ঞানী ও পবিত্র হিসেবে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে, মেলা- মজলিসে শ্রোতাদের থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য এবং মানুষকে হাসানোর নিমিত্তে মিথ্যা বলে থাকে। এদের জন্য নবী করীম তিনবার অনুশোচনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

وَيْلٌ لِمَنْ يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَّهُ অর্থাৎ অনুশোচনা তাদের জন্য, যারা কথা বলে আর জনতাকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে, তাদের জন্য অনুশোচনা, তাদের জন্য অনুশোচনা। । প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৪১২। মিথ্যা মুনাফিকসুলভ স্বভাব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

إِنَّ الْكِذَبَ بَابٌ مِّنْ أَبْوَابِ النِّفَاقِ

অর্থাৎ নিঃসন্দেহে মিথ্যা মুনাফেকীর দরজাসমূহের একটি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

ثلاث مِّنْ كُنْ فِيْهِ فَهُوَ مُنَافِقٌ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ إِذَا حَدَّتَ كَذِبَ অর্থাৎ যার মধ্যে তিনটি স্বভাব থাকবে

وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ সে মুনাফিক; যদিও রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং নিজকে মুসলমান মনে করেঃ যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখলে খিয়ানত করে।  দ্বারা মানুষের ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। মিথ্যাবানী প্রমাণিত হলে মুহাদ্দিসীনে কেরাম তাদের থেকে হাদীস গ্রহণ করতেন না। 

[বুখারী ও মুসলিম।


ঘটনা ঃ
হযরত শিবলী তা'আলা আনহু একজন উঁচু স্তরের ওলী ছিলেন। তিনি কোন অবাস্তব বিষয়কে উদাহরণ হিসেবেও গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। অথচ উদাহরণে দোষ নেই। তিনি একজন ওস্তাদের নিকট ইলমে নাহ শিক্ষার জন্য ওস্তাদ বললেন, পড়। (যায়েদ আমরকে মেরেছে)। তখন হযরত শিবলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু জিজ্ঞেস করলেন, বাস্তবে কি যায়েদ আমরকে মেরেছে? ওস্তাদ উত্তর দিলেন- মারে নি, তবে এটা একটা উদাহরণ। তখন হযরত শিবলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন- আমি এমন ইলম পড়বো না, যার ভিত্তিটাই মিথ্যার উপর। এ বলে তিনি চলে গেলেন।

নুজহাতুল মাজালিস, পৃষ্ঠা- ১১৯/ আগেই বলা হয়েছে- মিথ্যা সকল পাপের মূল ও উৎস। মিথ্যা বলে অস্বীকার করে মুক্তি পাবে এ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই মানুষ পাপাচারে লিপ্ত হয়। তাই প্রথমে উৎসকে বন্ধ করতে হবে। এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে বললো, “এয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মুসলমান হতে চাই। তবে আমার মধ্যে অনেক মন্দ স্বভাব আছে, যা আমি মোটেই ছাড়তে পারবো না। আমি ব্যাভিচার করি, মদ্যপান করি, চুরির অভ্যাসও আছে এবং মিথ্যাও বলি। আমাকে দয়া করে ওইগুলোর অনুমতি দিন। আমি ধীরে একটি একটি করে ত্যাগ করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে এরশাদ করলেন, “তুমি কি মিথ্যা ত্যাগ করতে পারবে?" লোকটি ভাবলো, এটাতো সহজ। আর বললো, "ঠিক আছে; আমি ওয়াদা করলাম-মিথ্যা ত্যাগ করবো।” এ বলে চলে গেলো। এখন সে তার অভ্যাস অনুযায়ী যখন যিনা করার ইচ্ছা করলো তখন চিন্তা করল আল্লাহর রাসূলের দরবারে যখন হাযির হবো তখন মিথ্যা বলতে পারবো না। আর সত্য বললে লজ্জিত হবো ও শান্তি পাবো। অতএব, সে যিনার ইচ্ছা ত্যাগ করলো। এভাবে মদ্যপানের ইচ্ছা করলো এবং রাতে চুরি করার ইচ্ছা করলো । ঠিক তার অন্তরে তখন ওই কথা এসে গেলো। ফলে মিথ্যা বলতে পারবে না বলে সে একেকটি করে সব পাপ কাজ পরিত্যাগ করে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেলো।
নুজহাতুল মাজালিস, পৃষ্ঠা- ১১৯/


মিথ্যা দু'ধরনের হতে পারে: ক. মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, নিজের লাভ, অন্যের ক্ষতির উদ্দেশ্যে অথবা পাপাচারের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে। এটা না জায়েয ও হারাম। আল্লাহ পাক বলেন- “তোমরা মিথ্যা কথা পরিহার করো। সূরা হাজ্জ, আয়াত- ৩০

 খ. বিবাদমান দু'ব্যক্তি বা দু'দলের সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অথবা কোন মুসলমানের কল্যানার্থে কিংবা কোন মুসলমানকে ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলা শুধু বৈধ নয়; বরং ক্ষেত্র বিশেষে ওয়াজিব হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِي يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ

অর্থাৎ ওই ব্যক্তি মিথ্যুক নয়, যে লোকদের মধ্যে মীমাংসা করে। মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৪১২। হযরত সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন-

الْكِذَبُ كُلَّهُ إِثْمٌ إِلَّا مَا نَفَعَ بِهِ مُسْلِمًا أَوْدَفَعَ عَنْهُ ضَرَرًا

অর্থাৎ প্রত্যেক মিথ্যা গুনাহ; তবে যে মিথ্যা দ্বারা কোন মুসলমানের কল্যাণ সাধিত হয় কিংবা কোন মুসলমানকে ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য বলা হয় তা বৈধ।

তোশকীলে কিরদার, উর্দু, পৃষ্ঠা-৭৬/

তবে যতক্ষণ সত্য দ্বারা সম্ভব হয় ততক্ষণ মিথ্যার আশ্রয় না নেয়াই শ্রেয়। সর্বদা মনে রাখতে হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী

الصدقُ يُنْجِي وَالْكِذَبُ يُهْلِكُ

অর্থাৎ “সত্য মুক্তি  দান করে আর মিথ্যা ধ্বংস করে।”

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!