চোগলখোরীর বা পরনিন্দাকারীর আজাব

Muhammad Jamal Uddin
0

চোগলখোরীর বা পরনিন্দাকারীর আজাব

 চোগলখোরী :

একজনের কথা কিংবা দোষ অপরজনকে বলে বেড়ানোকে চোগলখোরী বলা হয়। চোগলখোরী অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ। এটা হারাম। এর ফলে ইসলামের কাম্য ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। সমাজে, পরিবারে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে কলহ-বিবাদ লেগে থাকে। স্বর্গীয় পরিবেশ নরকে পরিণত হয়। পবিত্র ক্বোরআনে বলা হয়েছে-

وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ تُمَزَةٍ

তরজমাঃ প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ।

[সূরা হুমাযাহ, আয়াত-১]

চোগলখোর সমাজে সর্বদা ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করায় লিপ্ত থাকে। একজনের বিরুদ্ধে আর একজনকে কিভাবে ক্ষেপাবে সে চিন্তায় রাত দিন মগ্ন থাকে। ফলে নিজেও শান্তি পায় না অপরকেও শান্তিতে থাকতে দেয় না। এরা সমাজবিধ্বংসী কীট। এদেরকে কেউ পছন্দ করে না।

আল্লাহ বলেন-

وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ

তরজমাঃ আল্লাহ ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।

পৃথিবীতে ফিত্না-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা মুনাফিক্বের চরিত্র। পবিত্র ক্বোরআনে আছে-  

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ لَا تُفْسِدُوا فِى الأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَلا ٥ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُالْمُفْسِدُونَ وَلَكِنْ لَا يَشْعُرُونَ

তরজমাঃ যখন মুনাফিক্বদেরকে বলা হয়, 'দুনিয়ায় ফিতনা ফ্যাসাদ করো না।' তখন তারা বলে, ‘আমরাতো সংশোধনকারী'। সাবধান! তারাই ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্দি করে না। - চোগলখোর জান্নাতে যাবে না। রাসুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- (পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।)
সূরা বাকারা, আয়াত- ১১-১২।

[ মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৪১১

অর্থাৎ তারা অন্যান্য সৎ কর্মপরায়ণদের সাথে প্রথম পর্যায়ে বেহেশতে যাবে না; বরং তারা কৃতকর্মের প্রতিফল তথা শাস্তি ভোগ করার পর প্রবেশ করবে।চোগলখোরের কবরে আযাব চোগলখোর দুনিয়াতে যেমন লাঞ্চিত হয় তেমন কবরেও কঠিন শাস্তি ভোগ করে। বোখারী ও মুসলিম শরীফে একাধিক স্থানে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসে, হযরত ইবনে রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদা দু'টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ যাত্রাবিরতি করে বললেন- এ দু'টি কবরবাসীর উপর আযাব হচ্ছে; কারণ ওদের একজন করতো আর অপরজন প্রস্রাব হতে ভালভাবে পবিত্রতা অর্জন করত না। । মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৪21

মৌলভী আবদুল হাই লক্ষ্মৌভী ‘তাম্ববীহুল গাফেলীন'-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন, জনৈক আনসারী সাহাবীর বোনের ইন্তেকাল হলো। কাফন-দাফন শেষে বাড়ী ফিরে তার স্মরণ হলো যে, তার টাকার থলে কবরের ভিতর রয়ে গেছে। অতঃপর কবর খনন করে তা নিতে গিয়ে দেখলো কবরে আগুন । বোনের মর্মান্তিক পরিণতি প্রত্যক্ষ করে সে তাড়াতাড়ি মাটি দ্বারা ঢেকে দিয়ে মায়ের

কাছে গিয়ে ঘটনার বিবরণ দিলেন। তার আমল সম্পর্কে মাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে মা বললেন, তার তেমন কোন দোষ ছিল না; তবে তার চোগলখোরীর অভ্যাস ছিলো, নামায বিলম্বে পড়তো এবং পাক-পবিত্রতায় উদাসীন থাকতো। এ কারণেই খুব সম্ভব তার এই আযাব হচ্ছে। । গীবত ও মুকাশাফাতুল কুলূব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৬৮। চোগলখোর আল্লাহর নিকট অতি নিকৃষ্ট ও ইতর। মানুষের ঘৃণার পাত্র হয় চোগলখোর। এদেরকে দেখলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কথা বলা বন্ধ করে দেয় এবং তাদের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। চোগলখোর ওলীদ ইবনে মুগীরাকে কোরআনে পাকে হারামযাদা তথা 'জারজসন্তান' বলে চিহ্নিত করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

خِيارُ عِبَادِ اللَّهِ الَّذِينَ إِذَا رُأُوَاذُكِرَ اللهُ وَشِرَارُ عِبَادِ اللَّهِ الْمَشَّاؤُنَ بِالنَّمِيمَةِ الْمُفَرِّقُونَ بَيْنَ الْاحِبَّةِ الْبَاغُونَ أَبَرَاءَ الْعَنَتَ

অর্থাৎ আল্লাহর প্রিয়বান্দা তারা, যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট বান্দা তারা, যারা মানুষের পরোক্ষ নিন্দা করে বেড়ায়। বন্ধুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং পূত পবিত্র লোকদের পদস্থল কামনা করে।

মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৪১৫।

অর্থাৎ চোগলখোরীর মাধ্যমে ভাল মানুষদেরকে বিপর্যয়, পাপাচার, ধ্বংস, পতন ও ব্যাভিচারে ফেলার সুযোগের সন্ধান করে।

চোগলখোরের দো'আ তো দূরের কথা তার কারণে অন্যদের দো'আও কবুল হয় না। ফলে সে শুধু নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, অপরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাদের কারণে আল্লাহর রহমত ও নিমাত হতে সবাইকে বঞ্চিত হতে হয়।

ঘটনা :
হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর সম্প্রদায় বনী ইস্রাইলে একদা অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। হযরত মূসা আলায়হিস সালাম তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে লাগাতার তিনদিন বৃষ্টির জন্য দো'আ করলেন; কিন্তু দো'আ কবুল হয়নি, বৃষ্টিও হয়নি। হযরত মূসা আলায়হিস সালাম আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন- এর কারণ কি? তখন ওহী নাযিল হলো, হে মূসা! তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন চোগলখোর আছে। যার কারণে দো'আ কবুল হচ্ছে না এবং হবেও না।” হযরত মূসা আলায়হিস সালাম বললেন, “হে আল্লাহ! ওই বখত কে? আপনি আমাকে তার পরিচয় করিয়ে দিন, আমি তাকে বের করে দেবো।" আল্লাহ তা'আলা বললেন, “আমি চোগলখোরী করতে তোমাদেরকে নিষেধ করি আর আমি কিভাবে চোগলখোরী করবো?” হুকুম হল তোমরা সবাই একত্রে তাওবা করো, তাহলে দো'আ কবুল হতে পারে। অতএব সবাই খালেস অন্তরে তাওবা করলো আর তাৎক্ষণিকভাবে বৃষ্টি বর্ষিত হলো। কিমিয়ায়ে সাআদাত, পৃষ্ঠা- ২১৩, তাম্বীহুল গাফেলীন, আরবী, পৃষ্ঠা-১০৯।

 ইমাম ইয়াহিয়া আকসাম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, চোগলখোর চেয়ে অধিক ক্ষতিকারক। একজন চোগলখোর এক ঘন্টায় যা করতে পারে যাদুকর তা একমাসেও পারে না। [তাম্বীহুল গাফেলীন, আরবী [পৃষ্ঠা- ১০৮। 

কথিত আছে যে, চোগলখোরের কাজ শয়তানের কাজের চেয়েও ক্ষতিকর। কেননা শয়তানের কাজ হল ভিতরে, খেয়ালে ও প্ররোচনার মাধ্যমে, পক্ষান্তরে চোগলখোরের কাজ প্রত্যক্ষ ও সামনাসামনি। তাম্বীহুল গাফেলীন, আরবী, পৃষ্ঠা- ১০৮। আরবী প্রবাদে চোগলখোরকে JL তথা লাকড়ি বাহক বলা হতো। অধিকাংশ মুফাসসির ক্বোরআনের আয়াত থেকেও 'চোগলখোর' অর্থ নিয়েছেন। শুকনো লাকড়ি যেমন আগুনের ইন্ধন হয়, চোগলখোর ব্যক্তিবর্গও পরিবারে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। প্রাগুক্তা

হযরত মাস'আব ইবনে জুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, আমার মতে চোগলখোরের কথা শোনা চোগলী করার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ। চোগলখোরের উদ্দেশ্য হলো উত্তেজিত করা আর শ্রবণকারী তা কবূল করে তাকে উৎসাহিত করা।

কিমিয়ায়ে সা'আদাত, পৃষ্ঠা ৩৯৪। হযরত হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ব্যক্তি তোমার সামনে অন্যের কথা বলে সে অবশ্যই তোমার কথা অন্যের কাছে বলে বেড়াবে। সুতরাং সর্বাবস্থায় চোগলখারের খপ্পর থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকা আবশ্যক।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!