ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা)-এর অবদান

Muhammad Jamal Uddin
0


ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা)-এর অবদান


ইসলাম গ্রহণ ও ইসলামের খেদমত :

হযরত আবু বকর পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ হিসেবে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মেরাজের কথা বিশ্বাস করেন বলে মহানবি (স) তাকে 'সিদ্দিক' উপাধিতে ভূষিত করেন। মদিনার মসজিদ ও মহানবি (স)-এর বাসগৃহ নির্মাণ, তাবুক অভিযান এবং বদর, উহুদ ও খন্দক তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন । হযরত ওমর (রা) বলেন “আবু বকরকে ইসলামের খেদমতের ব্যাপারে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না।" তিনি মহানবি (স)-এর কঠিনতম মুহূর্তে তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। হিজরতের মহাসংকটেও মহানবি (স) আবু বকরকেই তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন কাজে আবু বকরের এরূপ সাহায্যের জন্য মহানবি (স) ঘোষণা করেন, "যদি আল্লাহ ব্যতীত কাউকে বন্ধু বলতাম, তবে আবু বকরকেই (রা) বন্ধু বলতাম।” হযরত (স) আবু বকরের প্রতি এত সন্তুষ্ট। হয়েছিলেন যে, তাঁর ইমামতিতে তিনি বহুবার নামাজ আদায় করেন।

খিলাফত রক্ষা : 

ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন, “মুহাম্মদ (স)-এর মৃত্যুর পর খিলাফত প্রশ্নই ছিল ইসলামের প্রথম সমস্যা।” এ নিয়ে এক ও বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছিল। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মহানবি (স)-এর মৃত্যু হলে মুসলমানদের খলিফা কে হবেন এ নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি এ বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান না হবার পূর্ব পর্যন্ত রাসুলের (স) পবিত্র মরদেহের দাফন পর্যন্ত হয়নি। ইসলামের এই দুঃসময়ে জনসাধারণ কর্তৃক খলিফা নির্বাচিত হয়ে আবু বকরই (রা) সব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করেছিলেন। উইলিয়াম ম্যুর বলেন, “নির্বাচনে মতানৈক্যের অর্থ ছিল ইসলামকে বিভক্ত করা এবং সেই অবস্থায় ইসলামের পরিণাম ছিল ধ্বংস।


ভণ্ডনবিদের দমন :

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়তের সাফল্য অনেকের মনে নবুয়ত লাভের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। তাঁর জীবনের শেষ দিকে দেশের বিভিন্ন অংশে কিছু ভণ্ডনবির উদ্ভব হয় এবং নবিজির ইন্তেকালের সাথে সাথে তাদের দাবি চরমে পৌঁছে। এদের মধ্যে আসওয়াদ আনসি, মুসায়লামা, তোলায়হা এবং সাজাহ ছিল প্রধান। অতঃপর মুহাম্মদ (স)-এর সময়ই ফিরোজ দাইলামী কর্তৃক আসওয়াদ আনসি নিহত হয়। পরবর্তীতে আৰু বকর (রা) খালিদ বিন ওয়ালিদসহ কয়েকজন মুসলিম সেনাপতির নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়ে তোলায়হা, সাজাহ ও ইয়ামামার যুদ্ধে মুসায়লামাকে কঠোরহস্তে দমন করে ইসলামকে বিরাট বিপদ থেকে রক্ষা করেন।


স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন প্রতিহত : 

আৰু বকরের (রা) খিলাফত লাভের পরপরই রিদ্দা আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ম্যুরের ভাষায় "আরব উপদ্বীপ পুনরায় তার পূর্ববর্তী ধর্মে ফিরে যেতে লাগল।" হযরত আবু বকর (রা) তখন বুঝতে পারলেন সমগ্র উপদ্বীপে সর্বপ্রথম ধর্মত্যাগীদের আন্দোলন প্রতিহত করতে না পারলে বাইরে ইসলাম প্রচার করা তো দূরের কথা দেশের অভ্যন্তরেই ইসলামকে রক্ষা করা দুরূহ ব্যাপার হবে। তাই তিনি সাহস ও দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের দমন করেন। পি. কে. হিট্টি বলেন, "আবু বকরের সংক্ষিপ্ত শাসনকালের অধিকাংশ সময়টাই তথাকথিত বিদ্দা যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ছিল। "


রাজ্যবিস্তার :

আবু বকর (রা) কেবল ইসলামের অভ্যন্তরীণ অনৈক্যই প্রতিরোধ করেননি বরং তিনি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে আরবকে মুক্ত রেখে রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করেন । তিনি মুসান্না এবং খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে পারস্যে অভিযান চালিয়ে ও হীরা রাজ্য জয় করেন। অপরদিকে শোরাহবিল, আম, ইয়াজিদ এবং আবু ওবায়দার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী চারভাগে বিভক্ত হয়ে সিরিয়ায় অভিযান চালায়। তারা একত্রিত হয়ে আজনাদাইনের যুদ্ধে গ্রিক বাহিনীকে ভীষণভাবে পর্যুদস্ত করে। এভাবে আবু বকর বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে পারস্য এবং রোমান সাম্রাজ্য পথ সুপ্রশস্ত তিনি খিলাফতের সীমানা ইরাক ও সিরিয়ার ভূখন্ড পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।



কুরআনের রক্ষক :

হযরত আবু বকরের (রা) শাসনামলে ভন্ডনবি মুসায়লামাকে দমনের সময় ইয়ামামার যুদ্ধে প্রায় ৩০০ জন হাফিজ শাহাদাতবরণ করে। ফলে পবিত্র কুরআনের সংরক্ষণ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দেয়। এজন্য আবু বকর (রা) হযরত ওমরের (রা) পরামর্শে জায়েদ বিন সাবিত নামে এক সাহাবির নেতৃত্বে একটি কুরআন সংকলন কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি কুরআনের বাণীগুলো সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করে।


তিনি শুরা বা মদিনা রাষ্ট্রের রক্ষক :

আবু বকর (রা) ছিলেন গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ইন্তেকালের পর তিনি ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হয়ে মুসলিম রাষ্ট্র ও ইসলামকে আসন্ন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে ইতিহাসে ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “আবু বকর বিনীত অন দৃঢ় ছিলেন এবং নতুন রাষ্ট্রের শাসনকার্যে এবং জনগণের উপকারার্থে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। মন্ত্রণা পরিষদের সাহায্যে কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। রাজাকে দেশের আইনের অধীনে এবং দেশের আইনকে জনগণের ইচ্ছার অধীনে করে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও সমান অধিকার দান করে আবু বকর (রা) প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের গোড়াপত্তন করেন। তিনিই প্রথম দীন-দুঃখীর দুর্দশা দূর করার জন্য 'বায়তুল মাল' প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত আলী (রা) বলেন, “বিশ্বনবির পরে শ্রেষ্ঠতম মানুষ হচ্ছেন হযরত আবু বকর (রা)।” মূলত এসব কাজ করে তিনি নব গঠিত মদিনা রাষ্ট্রের ভিতকে শক্তিশালী করেছিলেন।


মূল্যায়ন : 

হযরত আবু বকর (রা) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তিনি মদিনার শিশু রাষ্ট্ররে বহিরাক্রমণের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি এর আয়তনও বৃদ্ধি করেন। ঐতিহাসিক মাসুদি বলেন “বস্তুত মহানবি (স)- এর ইন্তেকালের পর যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে আবু বকরের মতো একজন খলিফা না থাকলে ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্র কোনোটাই রক্ষা পেত না।" মূলত খিলাফত লাভের পরে ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সেবা, ভণ্ডনবিদের দমন, জাকাতবিরোধীদের দমন এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে তিনি দেশকে যেভাবে রক্ষা করেছেন তাতে নিঃসন্দেহে তাকে 'Saviour of Islam' বা ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা যায়।


হযরত আবু বকর-এর চরিত্রঃ

চারিত্রিক মাধুর্য : হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন মহান আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তাঁর আচার-ব্যবহার এতই সরল ও অকপট ছিল যে, হযরত ওমর, ওসমান, আলীসহ অনেক সাহাবি মহানবি (স)-এর পরে তাকে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদার মনের অধিকারী এবং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তাঁর মানবতাবোধ, দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা বিশ্বের ইতিহাসে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে।


চারিত্রিক দৃঢ়তা :

হযরত আবু বকর (রা) চারিত্রিক দিক থেকে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রমাণ মেলে নিরপেক্ষ বিচারে, নির্ভীক রাষ্ট্র পরিচালনায়। তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় হযরত ওমরসহ (রা) কতিপয় সাহাবি বেদুইনদের জাকাত প্রদান থেকে অব্যাহতি দেবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে হযরত আবু বকর (রা) এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে জাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। খলিফা হওয়ার পর তিনি সাহাবিদের অনুরোধে বার্ষিক ৬০০০ দিরহাম ভাতা গ্রহণ করতে রাজি হন। কিন্তু ওই অর্থ গ্রহণ করায় মৃত্যুকালে তিনি এত কষ্টবোধ করছিলেন যে, তিনি তার কিছু সম্পদ বিক্রি করে সেই অর্থ পরিশোধ করতে আদেশ দেন।


গণতন্ত্রের সাধক : 

আবু বকর (রা) ছিলেন গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। তিনি শুরা বা মন্ত্রণা পরিষদের সাহায্যে কুরআন সুন্নাহভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। রাজাকে দেশের আইনের অধীনে এবং দেশের আইনকে জনগণের ইচ্ছার অধীন করে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও সমান অধিকার দান করে আবু বকর (রা) প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের গোড়াপত্তন করেন। দানশীল ও বিশ্বাসী : ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা) 'আতিক' বা দানশীল হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি তাবুকের ব্যয়ভার বহনের জন্য নিজের সমস্ত সম্পদ দান করে এক অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। প্রথম পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ব্যক্তি হিসেবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মেরাজের কথা সর্বপ্রথম বিশ্বাস করেন, এ জন্য রাসুল (স) তাঁকে 'সিদ্দিক' বা বিশ্বাসী উপাধি দেন।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!