Mirazn Nabi(durud) - মি'রাজুন্নবী

Muhammad Jamal Uddin
0

           মি'রাজুন্নবী সাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম







عَنْ قَتَادَةَ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكِ عَنْ مَالِكِ بْنِ صَعْصَعَةَ أَنَّ نَبِيَ اللَّهِ الا حَدَّلَهُمْ عَنْ لَيْلَةٍ أُسْرِى بِهِ بَيْنَمَا أَنَا فِي الْحَظِيمِ ....... فَلَمَّا جَاوَزْتُ نَادَى مُنَادٍ أَمُضَيْتُ فَرِيضَتِي وَخَفَّفْتُ عَنْ عِبَادِى . متفق عليه

বঙ্গানুবাদ

হযরত ক্বাতাদা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক হতে, তিনি মালিক ইবনে সা’সা‘আ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে মি'রাজ রজনীর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে যে, আমি হাতিমে কা'বার অংশে শুয়েছিলাম হঠাৎ দেখলাম এক আগন্তুক এসে আমার বক্ষকে এখান থেকে এই পর্যন্ত অর্থাৎ কণ্ঠনালী থেকে নাভী পর্যন্ত বিদীর্ণ করলো। অতঃপর আমার ক্বলব বের করল আর আমার কাছে স্বর্ণের একখানা থালা আনা হলো, যা ঈমান ও বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ ছিল। তাতে আমার কলব ধৌত করা হলে আমার কলব ঈমান ও বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পরিশেষে তা যথাস্থানে রেখে দেয়া হয়। এরপর আমার সামনে আরোহনের একটি জন্তু হাযির করা হয়, যা আকারে খচ্চরের চেয়ে ছোট আর গাধার চেয়ে বড়। তার দৃষ্টি যতদূর যেত সেখানে সে পা রাখত। আমি তার উপর আরোহন করলাম। অতঃপর জিব্রাঈল (আগন্তুক) আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা করলেন এমনকি আমরা প্রথম আসমানে পৌঁছে গেলাম। জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম প্রথম আসমানের দরজা খুলতে বললে ভিতর থেকে আওয়াজ এলো, কে? উত্তরে বললেন, আমি জিব্রাঈল। আসমানের ফেরেশতারা আবার জিজ্ঞেস করল, আপনার সাথে কে? বললেন ‘মুহাম্মদ' (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি দাওয়াত করা হয়েছে? উত্তর দিলেন- হ্যাঁ। বলা হল, তাঁকে সাদর সম্ভাষণ, কতই উত্তম তার শুভাগমন। দরজা খুলে দেয়া হল। অতঃপর এখানে দেখা হয়ে গেল হযরত আদম আলায়হিস সালাম এর সাথে। জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন, তিনি আপনার পিতা সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম দিলাম। আর তিনি জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান পুত্র ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।


অতঃপর জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম আমাকে উপরের দিকে দ্বিতীয় আসমান পর্যন্ত নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন।ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করা হল কে? তিনি বললেন আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি দাওয়াত করা হয়েছে? জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন- হ্যাঁ। এবার আওয়াজ এল, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ, তাঁর শুভাগমন কতইনা উত্তম ও বরকতময়। এ বলে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর আমি দ্বিতীয় আসমানে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম ও হযরত ইয়াহইয়া আলায়হিস সালামকে। তারা দু'জন খালাত ভাই। জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন, এরা ইয়াহইয়া ও ঈসা, আপনি তাদের প্রতি সালাম প্রদান করুন। আমি তাদের প্রতি সালাম প্রদান করলাম। তাঁরা উভয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। 


অতঃপর জিরাঈল আমাকে তৃতীয় আসমানে নিয়ে হাবির হয়ে দরজা খুলতে বললেন, ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে? তিনি বললেন, আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল- আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি দাওয়াত করা হয়েছে? বিব্রাঈল বললেন, হ্যাঁ। এবার বলা হল, তাঁকে স্বাগতম, তাঁর শুভাগমন খুবই উত্তম ও বরকতময়। দরজা খুলে দেয়া হল। সাথে সাথে দেখা হয়ে গেল হযরত ইয়ুসুফ আলায়হিস সালাম এর সাথে। জিব্রাইল আলায়হিস সালাম বললেন, ইনি ইয়ুসুফ আলায়হিস সালাম তাঁকে সালাম প্রদান করুন। আমি তাঁকে সালাম প্রদান করলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন- পুণ্যবান ভাই ও পূণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।


 এরপর জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম চতুর্থ আসমানে আমাকে নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার কে আছে? তিনি বললেন, আমার সাথে আছেন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি ডেকে আনা হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। বলা হল, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ, তাঁর শুভাগমন কতই উত্তম ও বরকতময়! এই বলে দরজা খুলে দেয়া হল। অতঃপর আমি সেখানে পৌঁছা মাত্রই সাক্ষাৎ হল হযরত ইদরীস আলায়হিস সালাম এর সাথে। জিব্রাঈল বললেন, ইনি হযরত ইদরীস আলায়হিস সালাম, তাঁকে সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর সাদর সম্ভাষণ। 


অতঃপর জিব্রাঈল আমাকে নিয়ে উর্ধ্বলোকে গমণ করে পঞ্চম আসমানে পৌঁছেন আর দরজা খুলতে বললে, ভিতর হতে আওয়াজ আসল কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল- তাঁকে কি দাওয়াত করা হয়েছে? উত্তরে জিব্রাঈল বলে হ্যাঁ। পঞ্চম আসমানের দারোয়ান বললেন, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। তাঁর শুভাগমন কতই না উত্তম ও বরকতময়। আমি সেখানে পৌঁছে হযরত হারুন আলায়হিস সালাম এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করলাম। জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম। বললেন তিনি হযরত হারুন আলায়হিস সালাম, তাঁকে সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম প্রদান করলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। 


অতঃপর জিব্রাঈল আমাকে আরো ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে গেলেন এমনকি ষষ্ট আসমানে গিয়ে পৌঁছেন আর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেসা করা হল, কে? উত্তরে তিনি বললেন, জিব্রাঈল। পুনরায় জিজ্ঞেসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তরে বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেসা করা হল, তাঁকে কি দাওয়াত করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ওই ফিরিশতা বললেন, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। তাঁর শুভাগমন কতই উত্তম ও বরকতময়। আমি সেখানে হযরত মূসা আলায়হিস সালাম এর সাক্ষাৎ পেলাম। জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন, ইনি মূসা আলায়হিস্ সালাম, সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম প্রদান করলাম। সালামের জবাব দিয়ে তিনি বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর আমি যখন তাঁকে অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমার পরে এমন একজন পবিত্র যুবককে (নবীরূপে) পাঠানো হল, যাঁর উম্মতের সংখ্যা আমার উম্মতের সংখ্যার চেয়ে অধিক পরিমাণ বেহেশতে প্রবেশ করবে। 


অতঃপর জিব্রাঈল আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানে আরোহন করলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি দাওয়াত করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ঐ ফেরেশতা বললেন, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। তার শুভাগমন কতই উত্তম ও বরকতময়। সেখানে পৌঁছে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম এর সাথে সাক্ষাৎ হল। জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন ইনি আপনার পিতা হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম, তাঁকে সালাম প্রদান করুন। নবীজী এরশাদ করলেন, আমি তাঁকে সালাম প্রদান করলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান পুত্র ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উঠানো হলো। সিদরা বৃক্ষের ফল ছিল হাজর অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতা হাতির কানের ন্যায়। জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন, এটাই সিদরাতুল মুনতাহা। সেখানে চারটি নহর ছিল। দু'টি অপ্রকাশ্য অন্য দু'টি প্রকাশ্য।আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিব্রাঈল, এ নহরের তাৎপর্য কী? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য নহর দু'টো হল জান্নাতের দু'টি ঝর্ণাধারা। আর প্রকাশ্য দু'টি হল (মিসরের) নীল ও (ইরাকের) ফোরাত নদী। অতঃপর বাইতুল মা'মূরকে আমার সম্মুখে প্রকাশ করা হল। তারপর আমাকে দেয়া হল একপাত্র শরাব, একপাত্র দুধ ও একপাত্র মধু। আমি দুধই গ্রহণ করলাম। জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বললেন, এটাই স্বভাবজাত ধর্ম (ইসলাম)'র নিদর্শন। আপনি এবং আপনার উম্মত এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। তারপর আমার উপর দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াকৃত নামায় ফরয করা হল। যখন আমি ফিরে চললাম তখন হযরত মূসা আলায়হিস সালাম বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায পড়তে সক্ষম হবে না। খোদার কসম! আপনার পূর্বে আমি লোকদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং বনী ইসরাঈলের সাথে আমি কঠোর নীতি অবলম্বন করেছি। অতএব, আপনি আপনার রবের কাছে আবার ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য নামায কমিয়ে দেয়ার আবেদন করুন। অতঃপর আমি আবারো আল্লাহর কাছে গেলাম। আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন। তারপর আমি মূসা আলায়হিস সালাম এর নিকট এলাম। তিনি এবারও অনুরূপ বললেন, আর আমি পুনরায় আল্লাহর নিকট গেলাম আর আবেদন করলাম; তিনি আবারো দশ ওয়াক্বত কমিয়ে দিলেন। তারপর মূসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে ফিরে এলে তিনি আবারো অনুরূপ বললেন। আমি আবার আল্লাহর কাছে ফিরে গেলাম। পরিশেষে আমাকে প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ দিলেন। আমি মূসা আলায়হিস সালাম এর কাছে ফিরে এলাম। তিনি আমার উপর আদিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি বললাম, আমার উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ করা হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত পাঁচ  ওয়াক্ত পড়তে সক্ষম হবে না। আপনার পূর্বে আমি লোকদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং বনী ইসরাঈলের প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেছি। তাই আপনি পুনরায় আপনার প্রতিপালকের দরবারে গিয়ে আপনার উম্মতের জন্য (নামায) আরো হ্রাসের আবেদন করুন। নবী করীম এরশাদ করেন, আমি আমার মহান রবের কাছে কয়েকবার (নামায হ্রাস করার) আবেদন করেছি। আমার লজ্জাবোধ হচ্ছে। অতএব এখন আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট এবং আমার প্রতিপালকের আদেশে আনুগত্য প্রকাশ করছি। করীম এরশাদ করেন, আমি সালামকে অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম। তখন জনৈক আহ্বানকারী আওয়াজ মূসা আলায়হিস দিয়ে বললেন, আমার আদেশ আমি জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের জন্য তা লঘু করে দিলাম। -[বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, ৫৪৮ পৃষ্ঠা


মি'রাজ রজনীতে নবীজীর স্বচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ

الله يَقُولُ لَمَّا كَذَّبَنِي قُرَيْشٍ عَنْ جَابِرٍ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ على قَمَتُ فِي الْحِجْرِ فَجَلَّى اللهُ لِى بَيْتَ الْمُقَدَّسِ فَطَفِقْتُ أُخْبِرُهُمْ عَنْ

اياتِهِ وَأَنَا أَنظُرُ إِلَيْهِ مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ

হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছেন- যখন কোরাইশরা মি'রাজের ঘটনার ব্যাপারে আমাকে অস্বীকার করতে চাইল তখন আমি মকামে হিজরে দাঁড়ালাম আর আল্লাহ্ পাক বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে আমার সামনে উপস্থাপন করলেন। আর আমি সেই বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে দেখে দেখে তাদের সকল প্রশ্নের জবাব দিলাম।

-[বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফ।

মি'রাজ রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম'র অন্যতম প্রধান মু'জিযা। এ মু'জিযা সংঘটিত হয়েছিল নবী-ই আকরামের নুবূয়ত প্রকাশের ১১ বছর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়।

নুবূয়তের একাদশ পবিত্র রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সৌরজগত, সিদরাতুল মুন্তাহা, আরশ-কুরসী ভ্রমণ করে লা-মকানে খোদার সাথে দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কথাবার্তা শেষে পুনরায় মক্কা শরীফে ফিরে এসে দেখলেন বিছানাও গরম রয়েছে আর ঘরের দরজার শিকলও নড়ছে। পরের দিন নবী করীম যখন এ বিষয়কর মি'রাজের ঘটনার দিচ্ছিলেন তখন কোরাইশ বংশের কাফিররা কোনমতেই তা বিশ্বাস করতে রাহি জলো না; বরং সরাসরি তারা মি'রাজের সত্যতাকে প্রত্যাখ্যান করল।

পক্ষান্তরে আবূ জাহল হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রদিয়াল্লাহু আনহুকে বলল, “দেখো তোমাদের নবীর কাণ্ড। গত রাতেই নাকি তিনি সপ্ত আকাশ অতিক্রম করে আরশ-কুরসী পরিভ্রমণ করে আবার রাত শেষ হবার আগেই পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। আসলে এটা কী করে সম্ভব?” জবাবে সিদ্দীক্বে আকবর বললেন, “এবার সিদ্দীক্বে আকবর বললেন, নবীজী যদি এ কথা বলে থাকেন, তাহলে আমিই সর্বপ্রথম বিশ্বাস করলাম মি'রাজুন্নবী সত্য।”


মি'রাজের বর্ণনা পবিত্র ক্বোরআনের সূরা বনী ইসরাঈলের শুরুতেই এসেছে- الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ

الأقْصَى الَّذِى بَرَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ ايتَنَا ط إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ 0 “পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি আপন (মাহবূব) বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন। মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই, নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন।”

মিরাজকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে:

১. মক্কা শরীফ হতে মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত। এ অংশকে বলা হয় 'ইসরা’।

Mirazn Nabi(durud) - মি'রাজুন্নবী

বায়তুল মুক্বাদ্দাস হতে সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় “মি'রাজ'। ৩. সিদরাতুল মুন্তাহা হতে লা-মকান পর্যন্ত। এ অংশকে বলা হয় ‘ই’রাজ’। আর সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকে মি'রাজুন্নবী বলা হয়।

অল্প সময়ে এ বিশাল জগত পরিভ্রমণ করে ফিরে আসা সত্যিই বিস্ময়কর আল্লাহ'র কুদরত এবং নবী-ই আকরাম মু'জিযার তথা অলৌকিক ক্ষমতার সামনে এটা একেবারেই স্বাভাবিক। সাধারণ লোকের জন্য আশ্চর্যজনক মনে হবে বলেই আল্লাহ্ পাক কালামে মজীদে ‘সুবহানা' শব্দ দিয়ে মিরাজের বর্ণনা দিয়েছেন। ঈমানদার মাত্র এই কুদরতী শক্তিকে মেনে নেয়। নবী করীমের মি'রাজ স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছিল, না সশরীরে হয়েছিল? এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা-বিশ্বাস ও ফতওয়া হল- নবী-ই পাকের মি'রাজ সংঘটিত হয়েছিল। সশরীরে। কেবল স্বপ্নের মাধ্যমে মি'রাজ হলে এতে আশ্চর্যের কিছু থাকত না। আর কাফির-বেদ্বীনরাও এর বিরোধিতা করত না। কারণ, স্বপ্নের মাধ্যমে সাধারণতঃ অনেক কিছু দেখা যায়। সুতরাং মি'রাজ স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছে বললে নবী-ই পাকের এ মু'জিযার প্রকাশ হতো না।

‘আশি‘আতুল লুম‘আত’ কিতাবের ৪র্থ খন্ড ৫২৭ পৃষ্ঠায় শায়খই মুহাক্কিক হযরত আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি লিখেছেন-“মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ইসরা এবং মসজিদে হতে আসমান পর্যন্ত পবিত্র ক্বোরআনের দলিল দ্বারা প্রমাণিত ইসরা কেউ অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে আর হাদীসে মাশহুর দ্বারা প্রমাণিত মি'রাজ অস্বীকার করলে গোমরাহ হবে।”

শরহে আক্বাইদে নাসাফী'র ১০০ পৃষ্ঠায় রয়েছে-


الْمِعْرَاجُ لِرَسُولِ اللهِ فِي الْيَقْطَةِ بِشَخْصِهِ إِلَى السَّمَاءِ ثُمَّ إِلى مَا شَاءَ اللهُ تَعَالَى مِنَ حَقٌّ اَى ثَابِتٌ بِالْخَبَرِ الْمَشْهُورِ حَتى أَنَّ

مُنْكِرَهُ يَكُونُ مُبْتَدِعًا - অর্থাৎ: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম'র মি'রাজ স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় আসমানে পরিভ্রমণ অতঃপর সেখান থেকে আল্লাহ'র ইচ্ছায় ঊর্ধ্বলোকে গমন ও পরিভ্রমণ করা মাশহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এটার অস্বীকারকারী বিদ'আতী হিসেবে গণ্য হবে। শায়খ আহমদ মোল্লা জীবন রহমাতুল্লাহি আলায়হি লিখেন-

إِنَّ الْمِعْرَاجِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى قَطْعِى ثَابِتُ بِالْكِتَابِ وَإِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا ثابت بالْخَبَرِ الْمَشْهُورِ وَإِلى مَا فَوْقَهُ مِنَ السَّمَوَاتِ ثَابِتٌ بالا حادِ فَمُنكِرُ الأَوَّل كَافِرُ الْبَةً وَمُنْكِرُ الثَّانِي مُبْتَدِعٌ مُضِل ومنكر

الثَّالِثِ فَاسِقٌ -

অর্থাৎ: মসজিদে আকসা পর্যন্ত মি'রাজ ‘পবিত্র কিতাবুল্লাহ' দ্বারা প্রমাণিত, আসমান পর্যন্ত ভ্রমণ ‘হাদীসে মশহূর' দ্বারা প্রমাণিত আর তারও উপরে পরিভ্রমণ ‘খবরে আহাদ' দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং প্রথমটাকে অস্বীকারকারী নিঃসন্দেহে কাফির, দ্বিতীয়টির অস্বীকারকারী বিদ'আতী আর তৃতীয়টির অস্বীকারকারী ফাসিক। 
(তাফসীরাতে আহমদিয়া, ৩২৮ পৃষ্ঠা। মোল্লা আহমদ জীবন রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাফসীরে আহমদিয়া র ৩৩০ পৃষ্ঠায়)

আরো লিখেন- الاصْحُ أَنَّهُ كَانَ فِى الْيَقْظَةِ وَكَانَ بِحَسَدِهِ مَعَ رُوْحِهِ وَعَلَيْهِ أَهْلُ

السُّنَّةَ وَالْجَمَاعَةِ فَمَنْ قَالَ إِنَّهُ بِالرُّوحِ فَقَط أَوْ فِى النَّوْمِ فَقَط فَمُبْتَدِع

ضَالَ مُضِلَّ فَاسِقٌ - অর্থাৎ- বিশুদ্ধতম মত হল মি'রাজ রূহ বিশিষ্ট শরীর সহকারে সম্পন্ন হয়েছিল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা এটিই। যারা মি'রাজকে কেবল রূহানী (আত্মিক) কিংবা স্বপ্নিল বলে আক্বীদা পোষণ করে তারা বিদ'আতী, পথভ্রষ্ট এবং ফাসিক্ব।

(দরসে হাদা 303)

নবীজীর সশরীর মি'রাজ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে আরো বেশি প্রমাণিত। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। সূর্য পৃথিবী হতে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে। তাই সূর্য হতে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট। পবিত্র হাদীস শরীফের আলোকে প্রমাণিত চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র সবগুলো আমাদের প্রিয়নবীর নূর থেকে সৃষ্ট তথা নূরে মুহাম্মদীর একেকটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম শাখা। ক্ষুদ্রতম শাখার গতি এত বেশি হয়, তাহলে মূল নূরের গতি কত হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। তাই এক মুহূর্তে হাজার হাজার আলোকবর্ষ মাইল অতিক্রম করা নবী করীমের নূরানী সত্ত্বার জন্য একেবারেই সহজ। নবী-ই আকরাম স্বশরীরেই বিশাল নভোঃমণ্ডল পার হয়ে লা-মকানে মহান আল্লাহ্'র সাথে দীদার (সাক্ষাৎ) করেছেন এবং নব্বই হাজার কালাম করেছেন। যেমন- মিশকাত শরীফ ৬৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে হযরত আবদুর রাহমান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন-

قَالَ رَسُولُ اللهِ لا رَأَيْتُ رَبِّي فِي أَحْسَن صُورَةٍ فَوَضَعَ كَفِيهُ بَيْنَ كَتِفَيَّ فَوَجَدْتُ بَرَدَهَا بَيْنَ ثَدْيَسَى فَعَلِمُتُ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ -

অর্থাৎ- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি আমার প্রতি পালককে অতি সুন্দর আকৃতিতে দেখেছি অতঃপর তিনি আমার দু’কাঁধের মধ্যখানে তাঁর কুদরতী হস্ত মুবারক রাখলেন। এতে আমি আমার বুকে শীতলতা অনুভব করলাম এবং আসমান-যমীনের মধ্যে যত কিছু রয়েছে সবকিছুই জেনে নিলাম ।

হাদীস শরীফ থেকে দু'টি বিষয় পরিস্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে। প্রথমতঃ মি'রাজের রজনীতে নবী করীম মহান আল্লাহ পাকের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। আর ওলামা-ই কিরাম এ কথার উপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, রজনীতে নবীজী জাহেরী চক্ষু দ্বারাই মহান রব্বুল আলামীনের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছিলেন।

মি'রাজ হতে ফিরে নবী করীম দেখতে পেলেন বিছানা এখনো গরম রয়েছে। ভোরে তিনি তাশরীফ নিয়ে সকলের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। আবু জাহল গং তথা কোরাইশ দলপতিরা এ কথা শুনে পরীক্ষার ছলে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দরজা, জানালা ইত্যাদির বিবরণ জানতে চাইল। তারা এ কথাও জানত যে, নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইতিপূর্বে কোনদিন বায়তুল মুক্বাদ্দাসে যাননি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন সাথে সাথে জিব্রাঈল আমীনের মারফতে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্ণ চিত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার সামনে তুলে ধরলেন আর তিনি দেখে দেখে দরজা, জানালাইত্যাদির বর্ণনা বিস্তারিতভাবে দিয়ে দিলেন। এতেও হতভাগা কাফিররা নবীকরীমের মি'রাজকে বিশ্বাস করল না। পক্ষান্তরে হযরত আবূ বকর রদিয়াল্লাহু আনহু কোন প্রকার দলিল-প্রমাণ তালাশ ব্যতীত নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিলেন। এবং নিরেট সত্য বলে ঘোষণা দিলেন। নবী আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন- হে আবূ বকর মি'রাজের ঘটনা এভাবে বিশ্বাস করলে কেন? উত্তরে আবূ বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এয়া রসূলাল্লাহ্ ! এটাতো সহজ বিষয়। এর চাইতেও অনেক বড় বিষয় না দেখে আপনার কথায় বিশ্বাস করেছি। যেমন মহান আল্লাহকেও তো স্বচক্ষে দেখিনি। আপনার কথার উপর বিশ্বাস করেই মহান আল্লাহ'র উপর ঈমান এনেছি। সুতরাং আপনার কথায় বিশ্বাস রেখেই মিরাজের সত্যতার উপর নিরঙ্কুশ সমর্থন দিলাম। উত্তর শুনে নবীজী খুশী হলেন, আর তাঁকে ‘সিদ্দীক্ব-ই আকবর' উপাধীতে ভূষিত করলেন।



Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!