১৯৬৬ সালের ছয় দফা
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষার দাবিসংবলিত একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এটি ছয় দফা কর্মসূচি নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ২৩ মার্চ ১৯৬৬ লাহোরের এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ছয় দফা কর্মসূচি ঐতিহাসিক 'লাহোর প্রস্তাব' এর ভিত্তিতে রচিত। ছয় দফা দাবির দফাগুলো নিম্নরূপ-
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হবে। এটি সংসদীয় পদ্ধতির যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা হবে সার্বভৌম।
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। অন্যান্য বিষয় থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
৩.দেশের দুই অঞ্চলের জন্য সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু মুদ্রা লেনদেনের হিসাব রাখার জন্য দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে অথবা দুই অঞ্চলের একই মুদ্রা থাকবে। তবে সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে এক অঞ্চলের মুদ্রা ও মূলধন অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে। একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
৪.সব ধরনের কর ও শুল্ক ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হবে, যা দ্বারা ফেডারেল সরকার ব্যয় নির্বাহ করবে।
৫. বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তবে আয় থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে দেওয়া হবে।
৬. প্রদেশগুলো চাইলে তাদের আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিজস্ব মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন ও পরিচালনা করতে পারবে।
ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ' বা 'ম্যাগনাকার্টা' হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও ছয় দফা দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। এই দিন তেজগাঁও এলাকায় পুলিশের গুলিতো শ্রমিক নেতা মনু মিয়া নিহত হন। তিনি ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ। এ কারণে ৭ জুনকে ছয় দফা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আগরতলা পরিকল্পনা মামলা ও '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্য ক্রমে বাড়ছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড রুদ্ধ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বারবার তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে। তার পরও বঙ্গবন্ধুকে এ ভূখণ্ড স্বাধীন করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখা যায়নি। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নানা পেশার, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর তরুণ বাঙালি সদস্যদের যোগাযোগ হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন একদল সেনাসদস্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মতবিনিময় হয়। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু গোপনে ত্রিপুরা গমন করেন। সেখানে • ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও পরবর্তীকালে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। সেখানে তিনি শচীন্দ্রলালের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে বার্তা পাঠিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে সহযোগিতা কামনা করেন। এদিকে সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে কয়েকজন বাঙালি অফিসার ও সেনাসদস্য গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য সংঘটিত হতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। সারা পাকিস্তানে দেড় হাজার বাঙালিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ষড়যন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। তখন বঙ্গবন্ধু জেলে বন্দি ছিলেন। এ মামলাটি দায়ের করা হয় ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক হয়। সেখানে ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিক ল্পনা করা হয়। এজন্য মামলাটির নাম হয় 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' সরকারি নথিতে মামলার নাম হলো ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য'। ১৯৬৬ সালের ৯ মে ছয় দফা আন্দোলনের কারণে জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বেকসুর খা দেওয়া হয়; আবার ১৮ জানুয়ারি সামরিক আইনে জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। এ মামলায় ৩৫ জন অভিযুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অন্য ৩৪ অভিযুক্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঁচজনের নাম হলো- ১. লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, ২. স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ৩. ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, ৪. সার্জেন্ট জহরুল হক, ৫. ক্যাপটেন শওকত আলী।
আগরতলা মামলার বিচারকাজ পরিচালনার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন বেলা ১১টায় মামলার শুনানি শুরু হয়। প্রখ্যাত আইনজীবী আব্দুস সালাম খানের নেতৃত্বে অভিযুক্তদের আইনজীবীদের নিয়ে একটি ডিফেন্স টিম গঠন করা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিরা ব্রিটেনের প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী হিসেবে প্রেরণ করে। পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রধান কৌসুলি ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ও অ্যাডভোকেট জেনারেল টিএইচ খান। ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এসএ রহমান। অপর দুই বিচারপতি ছিলেন এমআর খান ও এম হাকিম। বিচারকাজ চলার সময় পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জোরদার হয়। আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলনে জনগণ যখন মুখর, তখন ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ‘ডাকসু' কার্যালয়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া ও মেনন উভয় গ্রুপ), জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ (দোলন গ্রুপ) সাংবাদিক সম্মেলন করে স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি - (SAC) গঠন করে এবং ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ছাত্রদের ১১ দফা ঘোষিত হলে জনগণ ছাত্রসমাজের ডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয় এবং সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ছাত্রদের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়েই ৮টি রাজনৈতিক দল মিলে ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারির DAC (Democratic Action Committee) গঠন করে। দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ইত্যাদি। DAC আট কর্মসূচি ঘোষণা করে। SAC-এর ১১ দফা ও DAC-এর আট দফার ভিত্তিতে আন্দোলন বেগবান হয়। SAC-এর ১১ দফার মধ্যে একটি দফা ছিল ছয় দফা। ২০ জানুয়ারি '৬৯-এর গণ-আন্দোলনের মাইলস্টোন। সেদিন পুলিশের গুলিতে অন্যতম ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। ২৪ তারিখে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর এবং খুলনায় তিনজন নিহত হন। ২৪ জানুয়ারিকে বর্তমানে গণ-অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালন করা হয়।