উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব

Muhammad Jamal Uddin
0
উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব

 উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের রাজত্বকালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে দাহির শোচনীয়ভাবে পরাজিত এবং নিহত হন। মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ফলে উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের প্রায় ৩০০ বছর পর গজনির সুলতান মাহমুদ ১০০০-১০২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ১৭ বার অভিযান পরিচালনা করেন । 

 ময়েজউদ্দিন মোহাম্মদ বিন সামস ইতিহাসে শিহাবউদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরি নামে পরিচিত। কোনে কোনো ঐতিহাসিক ঘুরিদের পারসিক জাতি বলে অভিহিত করলেও ঐতিহাসিক লেনপুল তাদের আফগান জাতির বংশধর বলে অভিহিত করেছেন। গজনিতে ঘুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে মোহাম্ম ঘুরি উপমহাদেশে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ ঘুরি পৃথ্বীর চৌহানের বিরুদ্ধে প্রথম তরাইনের যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু এই যুদ্ধে ঘুরি শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও আহত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। 

পরের বছর ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার পৃথ্বীরা। চৌহানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং যুদ্ধে জয়লাভ করেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান এ যুদ্ধে নিহত হন; ফলে উপমহাদেশে বা ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। মোহাম্মদ ঘুরি উপমহাদেশের শাসনভার তার সুযোগ্য সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেকের ওপর নাস্ত করে গজনি প্রত্যাবর্তন করেন।




                                                                     দিল্লি সালতানাত
                                        



 দাস বংশ : কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন মোহাম্মদ ঘুরির একজন কৃতদাস। পরবর্তীতে তিনি ঘুরির সেনাপতি হন। তিনি মোহাম্মদ ঘুরির অনুমতিক্রমে ভারত বিজয়ের পর দিল্লিতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। উপমহাদেশের স্থায়ী মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আইবেক। তাকে দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়। কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন তুর্কিস্তানের অধিবাসী। এজন্য কুতুবউদ্দিন আইবেক ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের শাসনামলকে প্রাথমিক যুগের তুর্কি শাসন বলেও চিহ্নিত করা হয়। দানশীলতার জন্য তাকে ‘লাখবক্স' বলা হতো। দিল্লির কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ তার শাসনামলেই শুরু হয়। তিনি মিনারটির নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেননি। দিল্লির বিখ্যাত সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির নামানুসারে এই মিনারের নাম রাখা হয় কুতুবমিনার। কুতুবউদ্দিন আইবেকের জামাতা ছিলেন ইলতুতমিশ। তিনি ছিলেন প্রাথমিক যুগে তুর্কি সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । তাকে দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ভারতে মুসলমান শাসকদের মধ্যে তিনি প্রথম মুদ্রা প্রচলন করেন। তিনি কুতুবমিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। ইলতুতমিশের কন্যা সুলতানা রাজিয়া ছিলেন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণকারী প্রথম মুসলমান নারী। সুলতান নাছির উদ্দিন মাহমুদ সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য ‘ফকির বাদশাহ' নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কোরআন নকল ও টুপি সেলাই করে জীবিকানির্বাহ করতেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বিদ্যোৎসাহী ও গুণিজনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ‘ভারতের তোতা পাখি' নামে পরিচিত আমির খসরু ছিলেন তার সভাকবি ।


 খলজি বংশ : আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। পর্যটক ইবনে বতুতা আলাউদ্দিন খিলজকে দিল্লির শ্রেষ্ঠ সুলতান বলে অভিহিত করেছেন। তিনি প্রথম মুসলমান শাসক হিসেবে দক্ষিণ ভারত জয় করেন। তার সেনাপতি মালিক কাফুর ১৩০৬ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম দাক্ষিণাত্য জয় করেন। আলাউদ্দিন খলজি মূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। 


 তুঘলক বংশ : মোহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩২৫ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। মোহাম্মদ বিন তুঘলক রাজ্য শাসনের প্রত্যক্ষ অসুবিধা দূর করার জন্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী দিল্লি থেকে দেবগিরিতে স্থানান্তর করেন। তিনি সোনা ও রুপার মুদ্রার পরিবর্তে প্রতীকী তামার মুদ্রার প্রচলন করে মুদ্রা মান নির্ধারণ করে দেন। প্রতীক মুদ্রা জাল না হওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা সে যুগে ছিল না। ফলে ব্যাপকভাবে মুদ্রা জাল হতে থাকে। এ জন্য সুলতানকে এ পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হয়। তুঘলক বংশের শেষ সুলতান ছিলেন মাহমুদ শাহ। বিখ্যাত তুর্কি বীর তৈমুর ছিলেন মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের অধিপতি। শৈশবে তার একটি পা খোড়া হয়ে যায় বলে তিনি তৈমুর লঙ নামে অি ভহিত। ১৩৯৮ সালের তৈমুর ভারত আক্রমণ করেন। তৈমুরকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা মাহমুদ শাহের ছিল না। তিনি বিনাবাধায় দিল্লিতে প্রবেশ করেন। প্রায় তিন মাস ধরে অবাধে হত্যা ও লুন্ঠনের পর তিনি বিপুল সম্পদ নিয়ে ফিরে যান।



                                                               
                                                                     খানজাহান আলী





 খানজাহান আলী ছিলেন একজন মুসলিম ধর্মপ্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের একজন স্থানীয় শাসক। তিনি রাজা গণেশকে পরাজিত করে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামের পতাকা ওড়ান। তিনি বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত বিখ্যাত 'ষাটগম্বুজ মসজিদ' নির্মাণ করেন। মসজিদের নাম ষাটগম্বুজ হলেও মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১টি। মসজিদের ভেতরে ষাটটি স্তম্ভ বা পিলার আছে। মসজিদের চার কোণায় চারটি মিনার আছে। এটি বাংলাদেশের মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় মসজিদ। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ষাটগম্বুজ মসজিদকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে।


 লোদি বংশ : ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের কাছে দিল্লির লোদি বংশের সর্বশেষ সুলতান ইবরাহিম লোদির পরাজয়ের মাধ্যমে দিল্লি সালতানাতের পতন ঘটে। 




 মোগল সাম্রাজ্য




 মোগল সাম্রাজ্য জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে ইবরাহিম লোদিকে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। 


 পানিপথের যুদ্ধ পানিপথ উত্তর-পশ্চিম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের একটি শহর। এটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। > পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হয় ১৫২৬ সালে। এ যুদ্ধে সম্রাট বাবর সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করেন। এটি ভারতের ইতিহাসে কোনো যুদ্ধে প্রথম কামানের ব্যবহার। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ ১৫৫৬ সালে আকবরের সেনাপতি বৈরাম খান ও আফগান নেতা হিমুর মধ্যে সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে হিমু পরাজিত ও নিহত হন এবং আকবর দিল্লি অধিকার করে। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের মোগল-আফগান সংঘর্ষের অবসান ঘটে। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে আহম্মদ শাহ আবদালি ও মারাঠাদের মধ্যে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে আহমেদ শাহ আবদালি মারাঠাদের পরাজিত করেন। মারাঠা শাসকদের উপাধি ছিল পেশোয়া।



 মসলিন 

 মসলিন তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুত করা একধরনের সূক্ষ্ম কাপড় বিশেষ। মসলিন ছিল মোগল সম্রাটদের বিলাসের বস্তু । 



 মোগল সম্রাটদের বংশ তালিকা

 জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর 

সম্রাট হুমায়ুন

 সম্রাট আকবর 

সম্রাট শাহজাহান 

 সম্রাট জাহাঙ্গির 

 সম্রাট আওরঙ্গজেব
 সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (সর্বশেষ মোগল সম্রাট)



 জহির উদ্দিন মোহাম্মদ সাহসিকতা ও নির্ভীকতার জন্য ইতিহাসে 'বাবর' নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন। বর্তমান তুর্কিস্তানের অন্তর্গত ফরগনায় বাবরের জন্ম। বাবর মোগল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ‘তুক-ই-বাবর' নামের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বাবর তার জীবনের জয়-পরাজয়ের ইতিহাস সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। বাবরের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ুন ১৫৩০ সালে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট হুমায়ুন বাংলায় প্রবেশ করেন এবং গৌড় অধিকার করেন। তিনি গৌড় নগরের নাম পরির্তন করে ‘জান্নাতাবাদ' রাখেন। তিনি বাংলায় আট মাস অবস্থান করে দিল্লির দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু পথে বক্সারের নিকটবর্তী চৌসার নামক স্থানে শেরশাহ হুমায়ুনকে অতর্কিত আক্রমণ করেন। চৌসারের যুদ্ধে (১৫৩৯) পরাজিত হয়ে হুমায়ুন কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে দিল্লি পৌঁছেন। পরের বছর (১৫৪০ সাল) শেরশাহের বিরুদ্ধে আবার অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু কনৌজের কাছে বিলগ্রামের যুদ্ধে তিনি আবার পরাজিত হন। বিজয়ী শেরশাহ দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!